Site icon CPI(M)

To Practice The Revolutionary Legacy Of Friedrich Engels: EMS Namboodiripad

ফ্রেডেরিক এঙ্গেলসের মৃত্যুশতবর্ষে ই এম এস নাম্বুদিরিপাদের এই লেখাটি গনশক্তি পত্রিকার সৌজন্যে প্রাপ্ত

মার্কস জন্মগ্রহণ করেন ১৮১৮ সালে, তার জীবনাবসান ঘটে ১৮৮৩ সালে; আর এঙ্গেলসের জন্ম ১৮২০ সালে, মৃত্যু ১৮৯৫ সালে।

মার্কস’র মৃত্যু শতবর্ষ উদযাপন উপলক্ষে বার্লিনে একটি সেমিনারে আমার অংশগ্রহণের সুযোগ হয়েছিল। ১৯৯৪-৯৫ সাল এঙ্গেলসের মৃত্যু শতবর্ষ হওয়ায় ভারতে তা উদযাপন করা হচ্ছে।

এঙ্গেলস অত্যন্ত বিনয়ী মানুষ ছিলেন। তিনি এ কথা স্বীকার করে নিয়েছিলেন যে, মার্কস-এর অবস্থান ছিল তাঁর এবং অন্য সব কমরেডদের অনেক উপরে। এঙ্গেলস বলেছিলেন, “মার্কস ছিলেন সহজাত সৃজন ক্ষমতার অধিকারী একজন প্রতিভাধর ব্যক্তি।” আর আমরা সবাই বিশেষ কর্মদক্ষতা সম্পন্ন ব্যক্তি। ” সেই কারণেই দর্শন, রাষ্ট্রীয় অর্থনীতি, রাজনীতি, নন্দনতত্ত্ব সবকিছুই যা তারা যুগ্মভাবে সৃষ্টি করেছিলেন তা মার্কসবাদ নামেই পরিচিত। তার অর্থ এই নয় যে মার্কসীয় তত্ত্ব এঙ্গেলসের অবদান কিছু মাত্র কম ছিল। বস্তুত মার্কস যখন প্রারম্ভে আইন এবং রাজনীতিতে দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ দর্শনের প্রয়োগ নিয়ে বিস্তৃত ব্যাখ্যায় ব্যস্ত ছিলেন, এঞ্জেলস তখন রাষ্ট্রীয় অর্থনীতিতে মার্কসের তত্ত্বকে বিস্তৃত রূপদানে ব্যস্ত ছিলেন। তার ১৮৪৪ সালে লেখা ‘ রাজনৈতিক অর্থনীতির সমালোচনা প্রসঙ্গে ‘ মার্কসীয় তত্ত্বকে শুধু আরও উন্নত করতে সাহায্য করেনি, মার্কসের নিজস্ব তথ্য অনুসন্ধানে যথেষ্ট সাহায্য করেছিল। এরই ফলশ্রুতিতে মার্কসীয় রাজনৈতিক অর্থনীতির সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ফসল ক্যাপিটাল লেখা হয়েছিল।

এঙ্গেলস-এর ‘Critique of Political Economy’, ‘Conditions of the Working Class in England -1844’, এবং মার্কস – এর ‘Critique of Hegel’s Philosophy of Law’ সমস্তই ১৮৪৪ সালে লেখা হয়েছিল। যা রাজনৈতিক অর্থনীতি এবং রাষ্ট্রবিজ্ঞান এর ক্ষেত্রে এক নতুন তত্ত্বের জন্ম দিয়েছিল।

ক্যাপিটাল রচনার সময় মার্কস তার বন্ধুর অবদান এর ওপর নির্ভর করেছিলেন, সেই সঙ্গে এঙ্গেলস এককভাবে যা করতে সক্ষম হতেন তার চেয়ে বেশি দূর পর্যন্ত উন্নত করে প্রথম খন্ড সম্পূর্ণ করেছিলেন। এমনকি বইটি প্রকাশের জন্য প্রেসে লেখা পাঠানোর সময় বইটি পরিমার্জিত করার ব্যাপারে এঙ্গেলসের মতামত এবং পরামর্শ যে তাকে প্রভূত সাহায্য করেছিল তা এঙ্গেলসকে লেখা একটি চিঠিতে মার্কস স্বীকার করেছিলেন।

ক্যাপিটাল – এর দ্বিতীয় এবং তৃতীয় খণ্ড প্রকাশের আগেই যেহেতু মার্কস মারা যান, এঙ্গেলসকেই তার বন্ধু এবং সহযোগীর অসমাপ্ত কাজ সম্পন্ন করার দায়িত্ব নিতে হয়। ক্যাপিটাল – এর দ্বিতীয় এবং তৃতীয় খণ্ড উভয়ের যুগ্ম প্রয়াসেরই ফসল।

এমনকি ‘কমিউনিস্ট ইশতেহার’ যা উভয়ে যৌথভাবে রচনা করেছিলেন তা রচনাতেও এঙ্গেলস এর অবদান ছিল যথেষ্ট মূল্যবান। অনেকগুলো মূল সুত্রায়ন এঞ্জেলস ই প্রথম এককভাবে করেছিলেন যা পরবর্তীকালে ‘Principles of Communism’ নামে প্রকাশিত হয়।

আন্তর্জাতিক শ্রমিক শ্রেণীর আন্দোলনে তত্ত্বগত এবং ব্যবহারিক নেতৃত্ব দানের ক্ষেত্রে, মার্কস যতদিন বেঁচেছিলেন ততদিন তিনিই উভয়ের মধ্যে মুখ্য ভূমিকা পালনের সম্মান পেয়ে এসেছেন। এঙ্গেলস ও নিজেকে তার অনুজ সহযোগী বলেই মনে করতেন। এই প্রসঙ্গে এটা উল্লেখযোগ্য যে মস্কো থেকে প্রকাশিত মার্কস এবং এঞ্জেলস এর রচনাবলীর প্রথম দুটি খন্ডে তাদের যৌথ কর্মতৎপরতা শুরুর আগের স্ব স্ব লেখাগুলোই আলাদাভাবে প্রকাশিত হয় ১৮৩৮ – ৪২ সালে। অবশ্য পরবর্তী সমস্ত খন্ডেই তাঁদের লেখা যা যুগ্মভাবে এবং এককভাবে লেখা হয়েছিল – তা একত্রে প্রকাশিত হয়। আলাদাভাবে লেখাগুলোও তাদের পরস্পরের সাহায্য, সহযোগিতা এবং ভাবের আদান-প্রদানের ছাপ সুস্পষ্ট। তাদের সমস্ত লেখাই সেই অর্থে যুগ্মভাবে লেখা।

মার্কস-এর মৃত্যুর পর সঙ্গত কারণেই এঙ্গেলস আন্তর্জাতিক বিপ্লবী শ্রমিকশ্রেণীর আন্দোলনের অবিসংবাদি নেতা হিসাবে পরিগণিত হন। দেশে দেশে সর্বহারা বিপ্লবী বাহিনী তার উপদেশ, পরামর্শ ও নেতৃত্বের উপর নির্ভর করতেন। তার নিজস্ব তত্ত্ব মূলক রচনা যেমন Dialectics of Nature, Anti – Duhring, Origin of Family, Private Property and The State লেখার পাশাপাশি পুঁজির দ্বিতীয় এবং তৃতীয় খণ্ড সম্পাদনা করার কঠিন দায়িত্ব পালনের সঙ্গে সঙ্গে ভাতৃত্ব মূলক পার্টিগুলির সঙ্গে চিঠিপত্র আদান – প্রদান করা ছাড়াও তাদের সমস্যা সম্পর্কে তাত্বিক এবং ব্যবহারিক উপদেশ ও পরামর্শ দিয়ে এসেছেন। বস্তুতপক্ষে তিনি ছিলেন আন্তর্জাতিক বিপ্লবী আন্দোলনের বন্ধু, পথপ্রদর্শক ও পরামর্শদাতা।

এই প্রসঙ্গে ইতালির সমাজতন্ত্রীদের তিনি যে পরামর্শ ও উপদেশ দিয়েছিলেন – তা স্মরণ করা প্রয়োজন। সেই সময় ইতালিতে বিপ্লবী বিপ্লবী গণতান্ত্রিক আন্দোলন জোর দানা বেঁধে উঠেছিল। সোশ্যালিস্ট দের নেতৃত্বে শ্রমিকশ্রেণী এবং অন্যান্য গণতান্ত্রিক শক্তি সেখানে জোটবদ্ধ ছিল। বিপ্লবী আন্দোলনে জয়লাভ করে এই জোটের মোর্চা সরকার গড়ার সম্ভাবনা ছিল প্রবল। যদি প্রকৃতই তা হয় এবং সোশ্যালিস্ট দের সরকারে যাবার প্রস্তাব দেওয়া হয় – তাহলে তারা কি সেই প্রস্তাব গ্রহণ করবে না বর্জন করবে?

এঙ্গেলস এই প্রশ্নের সরাসরি বা প্রত্যক্ষ কোন জবাব দেন নি। ইতালির বাস্তব পরিস্থিতি সম্পর্কে সম্যক ধারণা না থাকায় তিনি এ প্রশ্নের সরাসরি জবাব দেবার অক্ষমতা জানিয়ে – তাঁর এবং মার্কস এর অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে সাধারণভাবে তার দৃষ্টিভঙ্গি এবং মতামত জানিয়ে সিদ্ধান্ত নেবার দায়িত্ব ইতালির কমরেড দের উপরে ছেড়ে দিয়েছিলেন। এই প্রসঙ্গে তিনি যে অভিমত দিয়েছিলেন তা হল :

সরকারে অংশগ্রহণের প্রস্তাব এলে ইতালির সোশ্যালিস্ট দের সরকারে সংখ্যালঘু সদস্য হিসাবেই যোগদান করতে হবে। ফলে তারা সরকারের নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে বিশেষ কোন প্রভাব বিস্তার করতে পারবেন না। অথচ সরকারের বুর্জোয়া শরিকদের সম্ভাব্য সমস্ত অপকর্ম এবং ব্যর্থতার দায় ভাগ তাদের উপরে বর্তাবে। ‘ যার ফল হবে মারাত্মক এবং বিধ্বংসী !’ অবশ্য একথাও তিনি বলেন, এমনটা নাও হতে পারে। তবু এ প্রশ্নের মীমাংসা ইতালির কমরেডদের নিজেদেরই করতে হবে। এবং সেই কারণেই তিনি সরাসরি এ প্রশ্নের জবাব দিতে অস্বীকার করেন।

এটা পরিষ্কার যে, এঙ্গেলস-এর মৌলিক অবস্থান ছিল শ্রমিকশ্রেণী যেখানে নীতিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে তার প্রভাব বিস্তার করতে পারে সেখানে সরকারে অংশগ্রহণ তার পক্ষে অবশ্যই  সুবিধাজনক। এঙ্গেলসের এই দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে লেনিনের ‘শিশুসুলভ বিশৃঙ্খলার’ কোনো উপাদান ছিল না।

বুর্জোয়া সংসদীয় ব্যবস্থায় (যেখানে সরকারে অংশগ্রহণের মাধ্যমে নীতিগত সিদ্ধান্তে প্রভাব বিস্তার সম্ভব) অংশগ্রহণ ও তাকে ব্যবহার করা বিপ্লবী কৌশল হিসাবেই বিবেচিত হবে। এঙ্গেলস পরবর্তী বিশ্ব সাম্যবাদী – আন্দোলন (স্বাধীনতা – উত্তর ভারতের মার্কসবাদী – লেনিনবাদি আন্দোলনের ইতিহাস সহ) এটাই প্রমাণ করে যে অতি বামপন্থীদের বুর্জোয়া সংসদকে বয়কট করা বা দক্ষিণপন্থী দের বুর্জোয়াদের লেজুড়ে পরিনত হবার নীতির বিরুদ্ধে সংসদীয় ব্যবস্থাকে বিপ্লবী সর্বহারা আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যাবার জন্য বামপন্থীরা অবশ্যই ব্যবহার করতে পারে।

মার্কস এর মতোই এঙ্গেলস ও তত্ত্ব এবং তার ব্যবহারের মধ্যে অতি ঘনিষ্ঠ যোগসূত্র স্থাপন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তত্বের ব্যাপারে তিনি ছিলেন যেমন অনমনীয় এবং আপোষহীন, ব্যবহারের ক্ষেত্রে তেমনি ছিলেন নমনীয়। ঠিক সেই কারণেই দুই বন্ধু মিলিতভাবে মার্কসবাদের তত্ত্বকে যথার্থভাবে প্রয়োগ করে আন্তর্জাতিক শ্রমিকশ্রেণীর আন্দোলনে বিভিন্ন ধরনের সংগঠন যেমন প্রথমে কমিউনিস্ট লিগে এবং পরে প্রথম আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছিলেন।

নিজের দেশসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মধ্যে যোগসূত্র স্থাপনা করে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠাতা এই দুই মহান ব্যক্তিত্ব আন্তর্জাতিক সর্বহারার আন্দোলনে ঐক্য স্থাপনা করতে পেরেছিলেন। এই কাজে মার্কসের অবস্থান এবং ভূমিকা ছিল সবার উপরে। তবে এঙ্গেলস এর অবদান ও কোনো অংশে কম ছিল না। মার্কস এর মৃত্যুর পর এঙ্গেলস ইউরোপের কমরেড দের দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠায় সর্বতো ভাবে সাহায্য করেছিলেন। তিনিই আবার তাঁদের দক্ষিণপন্থী বিচ্যুতি এবং সুবিধাবাদী ঝোঁকের কঠোর সমালোচনা করেছিলেন – যা পরবর্তীকালে এঙ্গেলসের মৃত্যুর পরে লেনিন ও করেছিলেন। দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের দক্ষিণপন্থী সোশ্যাল ডেমোক্রেসির বিরুদ্ধে লেনিন আপোষহীন সংগ্রাম গড়ে তুলেছিলেন। এই প্রক্রিয়াতেই লেনিনের নেতৃত্বে ১৯১৭ সালে রাশিয়ায় সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সংগঠিত হয় এবং তৃতীয় কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের ও প্রতিষ্ঠা হয়।

এঙ্গেলসের উত্তরসুরী হিসাবে লেনিন ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থার পরিবর্তনের দিকগুলো ও পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে বিশ্লেষণ করেন। মার্কস এর মৃত্যুর পর ক্যাপিটাল এর প্রকাশিত সংস্করণের ভূমিকায় এঙ্গেলস যে তত্বের সূচনা করেছিলেন, তাই পরবর্তীকালে লেনিন ‘একচেটিয়া পুঁজি বা সাম্রাজ্যবাদ হলো ধনতন্ত্রের মরনোন্মুখ ধাপ’ তত্ত্বে আরো বিস্তৃতভাবে ব্যাখ্যা করেছেন।

মনে রাখা দরকার, এঙ্গেলস এর মৃত্যুবার্ষিকী এমন একটা সময়ে পড়েছে যখন আন্তর্জাতিক সর্বহারা বিপ্লবী আন্দোলন এক নতুন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। ১৮৪৮ – ৪৯ এ ইউরোপের বিপ্লব ব্যর্থ হবার পর মার্কস – এঙ্গেলস যে অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছিলেন , আজ আমরা যারা মার্কস, এঙ্গেলস, লেনিনের উত্তরাধিকারী তাদের অবস্থান ও একই। প্রায় দেড় শত বছর আগের মতই প্রতিক্রিয়ার শক্তি আজ সাময়িক জয় অর্জন করেছে সত্যি, সঙ্গে সঙ্গে এটাও সত্যি এবং তাদের মতো আমরাও জানি এ জয় খুবই সাময়িক।

সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং পূর্ব ইউরোপের সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিপর্যয়ের ফলে যে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হয় তা ক্রমশ ভাঙনের মুখে। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে বিশ্ব ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থায় যে দ্বন্দ্বগুলি ছিল তা আজও সর্বাংশে বিদ্যমান। যে বিপ্লবী শক্তি বিগত তিন চার বছর প্রতিক্রিয়ার শক্তির কাছে পর্যদুস্ত হয়ে আছে তা আবার নতুন করে শক্তিশালী হয়ে উঠতে বাধ্য। সেই কারণেই মার্কস, এঙ্গেলস এবং লেনিন থেকে শিক্ষা নিয়ে বর্তমান অবস্থায় আন্তর্জাতিক স্তরে এবং নিজের নিজের দেশে তা ব্যবহার করাটা আজ আরো বেশি জরুরি হয়ে পড়েছে।

Spread the word