Site icon CPI(M)

নব্য ফ্যাসিবাদকে হারিয়ে চিলিতে জয় বামপন্থার – শান্তনু দে…

২০ ডিসেম্বর ২০২১, সোমবার

ইতিহাসের মোড় ঘুরিয়ে চিলিতে জয়ী বামপন্থা ঘেঁষা প্রার্থী গ্যাব্রিয়েল বোরিক। ভয় আতঙ্কে হারিয়ে আশার জয়। নব্য-ফ্যাসিস্তদের হারিয়ে নেরুদা, আলেন্দে, ভিক্টোর হারার দেশে গণতন্ত্রের জয়।

‘চিলির বোলসোনারো’ উগ্র দক্ষিণপন্থী নয়া নাৎসী প্রার্থী আন্তোনিও কাস্ত’কে হারিয়ে রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত অ্যাপ্রুভ ডিগনিটি’র প্রার্থী বোরিক। বামপন্থা ঘেঁষা জোট ব্রড ফ্রন্ট এবং চিলির কমিউনিস্ট পার্টিকে নিয়ে গঠিত এই নির্বাচনী ফ্রন্ট। পিনোচেতপন্থী কাস্ত গত রাষ্ট্রপতি ভোটে বুক বাজিয়ে বলেছিলেন, ‘পিনোচেত বেঁচে থাকলে তিনিও আমায় ভোট দিতেন।’

১৯ নভেম্বর, প্রথমদফার ভোটে সবচেয়ে বেশি ভোট পেয়েছিলেন কাস্ত। সমর্থনের হার ছিল ২৭.৯ শতাংশ। বোরিক পেয়েছিলেন ২৫.৮ শতাংশ। রবিবার চূড়ান্ত পর্বের ভোটে বোরিক পেয়েছেন ৫৫.৮৭ শতাংশ ভোট। বিপরীতে কাস্ত ৪৪.১৩ শতাংশ। বছরপঁয়ত্রিশের বোরিক বলেছেন, ‘চিলি যদি নয়া উদারবাদের আঁতুড়ঘর হয়ে থাকে, এবার তা হবে নয়া উদারবাদের কবরস্থান।’

কাস্ত আকাশ থেকে পড়েননি। দীর্ঘদিন ধরে তিনি ছিলেন চিলির সংসদের সদস্য। উগ্র দক্ষিণপন্থী ইন্ডিপেনডেন্ট ডেমোক্রেটিক ইউনিয়নের (ইউডিআই) নেতা, যে দল ঘনিষ্ঠভাবে জড়িয়ে ছিল পিনোচেতের ফ্যাসিস্ত-সামরিক স্বৈরাচারের সঙ্গে। তাঁর বাবা মাইকেল কাস্ত ছিলেন হিটলারের নাৎসী দলের দলের সদস্য। নাৎসী বাহিনীর লেফটেন্যান্ট। জার্মান বাহিনীর হয়ে ফ্রান্স, সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং ইতালিতে যুদ্ধে গিয়েছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে পালিয়ে এসেছিলেন চিলিতে। তাঁর এক ছেলে মিগুয়েলকে পিনোচেত প্রথমে শ্রমমন্ত্রী করেন। পরে তাঁকে সেন্ট্রাল ব্যাঙ্কের প্রেসিডেন্ট করেন। মিগুয়েল ছিলেন মিলটন ফ্রিডম্যানের তথাকথিত ‘শিকাগো বয়েজে’র একজন। আরেক ছেলে ক্রিস্টান কাস্ত ছিলেন পিনোচেত জমানায় কৃষক গণহত্যার সঙ্গে জড়িত। আর আন্তোনিও কাস্ত ছিলেন চিলির নতুন সংবিধান লেখার জন্য গণভোটের বিরুদ্ধে। এহেন কাস্ত পরিবারের সন্তান আন্তোনিও এবারেও নির্বাচনী প্রচারে বলেছিলেন, ‘আমি পিনোচেতবাদী নই, তবে উনি যা করেছেন, তাঁর মূল্য দিই।’ তাঁর মতে, পিনোচেতের স্বৈরতন্ত্র ‘আধুনিক চিলির ভিত তৈরি করেছে।’

ভোটের কুড়িদিন আগে কাস্ত ছুটে গিয়েছিলেন ওয়াশিংটনে (যেমন ২০১৭-তে ভোটের আগে গিয়েছিলেন বোলসোনারো)। কাস্ত গিয়ে দেখা করেছিলেন ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ মার্কিন সেনেটের রিপাবলিকান সদস্য কিউবার বংশোদ্ভূত মার্কিন নাগরিক মার্কো রুবিও’র সঙ্গে। যাঁর সঙ্গে লাতিন আমেরিকার দক্ষিণপন্থীদের রয়েছে গভীর যোগাযোগ। রুবিও’র সঙ্গে কাস্তের বৈঠকে ছিলেন অর্গানাইজেশন অব আমেরিকান স্টেটসে (ওএএস) চিলির রাষ্ট্রদূত ইসা কোর্ট। ছিলেন পেপসিকো, ইউনাইটেড হেলথ গ্রুপের মতো অন্তত ২০টি দাপুটে সংস্থার কর্তা।

যদিও লাভ হয়নি। চিলি ফিরেছে বামপন্থায়।

একদিনে নয়। একবছর ধরে রাস্তায় লড়াই। কারফিউ। সেনা জওয়ানদের বেয়নটের মুখেও অকুতোভয়। সশস্ত্র বাহিনীর বর্বর দমনপীড়ন। যৌন হিংসা। এমনকি ধর্ষণ পর্যন্ত। এক প্রতিরোধের বিস্ফোরণ। এবং শেষে সাফল্য। সান্তিয়াগোর প্রাণকেন্দ্রের ঢাউস ব্যানার: ‘বিদায় জেনারেল! নতুন সংবিধান চেয়েছি আমার শ্রেণির জন্য।’

শ্রেণিসংগ্রামের পাটিগণিত: এই বিশ্বের সবচেয়ে অসাম্যের দেশগুলির অন্যতম চিলি। জিডিপি বৃদ্ধির হার ২০১৮-তে ছিল ১.১ শতাংশ, যেখানে বৃহত্তম কর্পোরেশনগুলির মুনাফা বেড়েছে ১০-গুণের বেশি। কী কারণে এই প্রকট ব্যবধান, তা বুঝতে কারো অসুবিধা হয়নি। চিলি দেখেছে জল, বিদ্যুৎ, গ্যাস, স্বাস্থ্য, ওষুধ, পরিবহন, শিক্ষা এমনকি হিমবাহের বেসরকারিকরণ।

‘উৎখাতের মাধ্যমে কেন্দ্রীভবনের’ এক ধ্রুপদী উদাহরণ চিলি। ক্রমশ অসহনীয় হয়ে উঠছে ১ কোটি ৯০ লক্ষ মানুষের অধিকাংশের জীবনধারণ। যে চিলিতে মাথাপিছু আয় বছরে ২৫,০০০ ডলার, সেখানে অর্ধেক শ্রমিকের বেতন মাসে ৫৫০ ডলারের কম।

১৪ অক্টোবর, ২০১৯। মেট্রোরেলের ভাড়া বৃদ্ধির প্রতিবাদে হাইস্কুলের ছাত্রদের বিক্ষোভ দিয়ে শুরু। মেট্রোর ভাড়া ৩.৭৫ শতাংশ (৩০ পেসো) বাড়ানোর প্রতিবাদে বিক্ষোভে ফেটে পড়েন ছাত্ররা। দ্রুত এই আন্দোলন এক অন্য মাত্রার চেহারা নেয়।

দাবি তখন নিছক ‘৩০-পেসো নয়, ৩০-বছরের অসাম্যের অবসান।’

মানুষ চান নয়া উদারবাদের বিকল্প। রাষ্ট্রপতি পিনেরার অবিলম্বে পদত্যাগ। একটি নতুন সরকার। তাঁরা চান মজুরিবৃদ্ধি, যা হবে দারিদ্রসীমার উপরে। ৪৫ নয়, সপ্তাহে ৪০-ঘণ্টা কাজ। ট্রেড ইউনিয়নের অধিকার, যৌথ দর কষাকষির নিশ্চয়তা। নাগরিক পরিষেবাসহ স্ট্র্যাটেজিক ক্ষেত্রের জাতীয়করণ। বেসরকারি পেনশন তহবিলের অবসান। ছাত্রদের ঋণমকুব। জলের কর ব্যবস্থার অবসান। প্রগতিশীল কর-কাঠামো। একটি নতুন অভিবাসী নীতি। শিক্ষা থেকে স্বাস্থ্য, রাজনীতি থেকে অর্থনীতির— কাঠামোগত পরিবর্তন। সবমিলিয়ে একটি নতুন সংবিধান। আর তার খসড়া লেখার জন্য একটি নতুন নির্বাচিত গণপরিষদ।

শেষে এবছর ১৬ মে, চিলির জন্য ছিল এক ঐতিহাসিক দিন। নতুন সংবিধান লিখতে গণপরিষদের নির্বাচন দেখেছে এক রাজনৈতিক ভূকম্পন। যা পুরোপুরি বদলে দিয়েছে দেশের রাজনৈতিক ক্যানভাস। নয়া উদারবাদ অবসানে এক নির্ণায়ক জনাদেশ। স্বৈরাচারী পিনোচেত জমানার অবসানের পর থেকে বামপন্থীদের অন্যতম বৃহত্তম জয়। নেরুদা, ভিক্টর হারা, আলেন্দের চিলিতে ইতিহাসের নতুন পাতা।

জোর ধাক্কা খেয়েছে রাষ্ট্রপতি সেবাস্তিয়ান পিনেরাকে ঘিরে উগ্র দক্ষিণপন্থী জোট। ১৫৫-সদস্যের গণপরিষদে পেয়েছে মাত্র ৩৭টি আসন। নেই ভেটো দেওয়ার ক্ষমতা। যার জন্য প্রয়োজন এক-তৃতীয়াংশ, অন্তত ৫২টি আসন। যেখানে কোনও সিদ্ধান্তের অনুমোদনের জন্য জরুরি দুই-তৃতীয়াংশ আসন। সমর্থনের হার মাত্র ২০.৫৬ শতাংশ। ১৯৬৪’র পর সবচেয়ে শোচনীয় পরাজয়। নির্বাচনের তাৎপর্যপূর্ণ দিক হলো নির্বাচিত ১৫৫ জনের অর্ধেক ৭৯ জনই মহিলা। ৭৬ জন পুরুষ। আদি জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন ১৭ জন। তাক লাগিয়ে দেওয়ার মতো তথ্য হলো, নির্বাচিতদের গড় বয়স ৪৫। যার অর্থ, সংবিধানের খসড়া তৈরিতে তারুণ্য নিতে চলেছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা।

এই চিলিতেই, এই গ্রহে প্রথম উদারনীতির পরীক্ষা।

স্বৈরাচারী সামরিক শাসক জেনারেল পিনোচেতের জমানায়। ১৯৮০, চিলির ওপর নতুন সংবিধান চাপিয়ে দেন তিনি। ওই সংবিধানই ঠিক করে দেয়: দেশ চলবে নয়া উদারনীতিতে। ১৯৯০, স্বৈরতন্ত্রের অবসান হলেও, তারপর আট-বছর তিনি ছিলেন সেনাবাহিনীর কমান্ডার-ইন-চিফ। অবসর নেওয়ার পর আরও বারো-বছর ছিলেন চিলির সংসদের উচ্চকক্ষ সেনেটের দাপুটে সদস্য। এই সময়ে ৩৩-বার সংবিধান সংশোধন হয়েছে। কিন্তু বেসরকারিকরণের সঙ্গে জড়িত নয়া উদার কাঠামো থেকে গিয়েছে জীবন্ত। অটুট থেকে গিয়েছে নয়া উদারবাদের মডেল।

এহেন চিলিতে, পিনোচেতের সংবিধান বদলে নতুন সংবিধান চেয়ে মানুষ দিয়েছেন নির্ণায়ক রায়। গত অক্টোবরে, গণভোটে প্রায় ৭৮.২৭ শতাংশ মানুষ রায় দিয়েছেন নতুন সংবিধানের পক্ষে। কমিউনিস্ট-সহ প্রগতিশীলদের ডাকে সাড়া দিয়ে নতুন সংবিধান তৈরিতে সরাসরি নির্বাচিত গণপরিষদকেই বেছে নিয়েছেন ৭৯.২২ শতাংশ।

বলিভিয়া, পেরুর পর এবারে চিলি। লাতিন আমেরিকা লড়ছে। গণবিদ্রোহ থেকে ব্যালটে। অভিমুখ ফের বামপন্থায়। এবং লাতিন আমেরিকা শুধু লড়ছেই না। ভাঙছে নয়া উদারবাদী মডেলকে, তার মূল অক্ষ চিলি থেকে। এই গ্রহে নয়া উদারবাদের প্রথম পরীক্ষাগার ছিল চিলি। এহেন চিলিতে দক্ষিণপন্থীদের বরাবরের দাপট ভেঙে বামপন্থীরা, প্রগতিশীলরা তৈরি করেছেন এক নতুন সম্ভাবনা।

Spread the word