প্রভাত পট্টনায়ক
আমাদের দেশে যখন বিজেপি শাসনের অবসান ঘটবে, তখন এ যাবতকালে ভারতীয় সমাজ, রাজনীতি এবং অর্থনীতিতে যে বিপুল ক্ষতি হল তা নি:সন্দেহে পুনরুদ্ধার হবে। কিন্তু দুটি ক্ষেত্রে এই পুনরুদ্ধার কঠিন। এক, স্থাপত্য ধ্বংস। বাবরি মসজিদ কে ধ্বংস করার মধ্য দিয়ে এর শুরু, শুধুমাত্র সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ পোষণ করা ছাড়াও এটি বর্বরতার একটা উদাহরণ। ৪০০ বছরের স্থাপত্য কে ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়ার ইচ্ছে কোনো সভ্য, সংবেদনশীল দলের পক্ষে পোষণ করা সম্ভব নয়। সংসদ ভবনের সামনে আবার নতুন একটি কাঠামো তৈরী করায় পুরনো বিন্যাসটাই নষ্ট হয়ে গেছে। কেবলমাত্র ঔপনিবেশিকতা নস্যাৎ করা এই বর্বরতার সপক্ষে যুক্তি হতে পারেই না।
অন্য ক্ষেত্রটি হল, বিশ্ববিদ্যালয়কে ধ্বংস করা। যা বিজেপি সরকার ব্যাপক আকারে করছে এবং এর সম্পূর্ণ পুনরুদ্ধার করা প্রায় অসম্ভব -তাই আমরা উদ্বিগ্ন। একটা বিশ্ববিদ্যালয় তো শুধু কতগুলি বাড়ির সমাবেশ নয় যেখানে পড়ানো হয়, এই কাজ তো কোচিং সেন্টারেও হয়। বিশ্ববিদ্যালয় এমন একটা প্রতিষ্ঠান, একটা পরিসর যেখানে ভাবনাকে মূল্য দেওয়া হয়, ভাবনার বিকাশ হয়,মূল্যবোধ গড়ে ওঠে। বিশেষত তৃতীয় বিশ্বের সমাজে এরকম স্থান তৈরী করা খুবই কঠিন। ভারতের কৃতিত্ব যে ভারতে এমন অনেক গুলো স্থান আছে , এবং এই কৃতিত্বের একটা বড় কারণ এদেশের বিশাল ভৌগলিক আকার। আমাদের প্রতিবেশী দেশের শিক্ষাবিদরা সর্বদা আক্ষেপ করেন যে তাদের দেশে এইপ্রকার শিক্ষার পরিবেশ তৈরী করার পরিকাঠামো নেই। ভারতের ক্ষেত্রে আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল যে, সকলে একই ধারার চিন্তার অধিকারী হোন বা না হোন, প্রত্যেকেই নানা ধারার চিন্তার প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন।
যারা ফ্যাসিস্টিক বা স্বৈরাচারী তারা নিজেরা গুরুত্বপূর্ণ কোনো ভাবনা কে পোষণ করতে পারে না, এমনকী এইধরণের কোনো ভাবনাকে তারা শ্রদ্ধাও করতে পারে না, সুতরাং এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই যে বিজেপি এই মুক্ত চিন্তার শিক্ষাঙ্গন গুলোকে পরিকল্পিতভাবে ধ্বংস করছে , এবং আগামীতে আমাদের দেশের জন্য তা এক অপূরণীয় ক্ষতি হচ্ছে।
সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে ধ্বংসের যে প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল তা এখন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় অব্ধি সম্প্রসারিত হয়েছে। বিশ্বের অন্যতম সেরা স্নাতক স্তরের পাঠ্যক্রম ছিল দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের মত কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে। জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয় যা এদেশে সমাজবিজ্ঞানের নানা বিষয়ে গবেষণার মাধ্যমে ভারতবর্ষের শহুরে আধিপত্যবাদকে প্রশ্নের সম্মুখীন করতে শিখিয়েছে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দৃষ্টিভঙ্গি শিক্ষা সম্পর্কে তাঁর ভাবনা থেকেই গড়ে উঠেছিল বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়। এদের অতীতের গৌরব এখন এরা হারিয়েছে। এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে উপাচার্য হিসাবে নিয়োগ করা হয়েছে আর এস এস অনুগতদের।মূলত এটাই এদের প্রাথমিক যোগ্যতা। বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল পদে নিযুক্ত করা হচ্ছে যোগ্যতাহীন আর এস এস এর কর্মীদের যার ফলে তারা বিশ্ববিদ্যালয়গুলি “দখল” করতে পারে। ছাত্র ভর্তির সময় একই কাজ তারা করেন । ডিন, চেয়ারপার্সন সব পদেই তারা নিজেদের তাঁবেদারদের ক্ষমতাসীন করেছে নিয়ম বর্হিভূত নিয়োগের মাধ্যমে এবং নানাভাবে মেয়াদ বৃদ্ধি করে। বিজেপি সরকার এই বিশ্ববিদ্যালয়গুলির গণতান্ত্রিকতাকেও নষ্ট করেছে। নিজেদের গুণ্ডাদের দিয়ে বিরোধীদের আক্রমণ করছে। শিক্ষার গুণগত মান হ্রাস পেয়েছে , এবং তার পাশাপাশি সব কয়টি বিশ্ববিদ্যালয় অর্থাভাবে ধুঁকছে।
সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়গুলির সকল ব্যবস্থার অবনতির সাথে সাথেই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়েও একই ঘটনা ঘটানো হচ্ছে। অশোকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যে ঘটনা ঘটেছে তা অত্যন্ত চাঞ্চল্যকর ও অভূতপূর্ব। ২০১৯ সালে অর্থনীতি বিভাগের লোকসভা নির্বাচনে বেশ কয়েকটি আসনে কারচুপি হয়েছে এই বিষয়ে এক অধ্যাপক একটি বিশ্লেষণাত্নক প্রবন্ধ লিখেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে এধরণের লেখা প্রায়শই হয়। কেবলমাত্র বিজেপি বাহিনী যে তাকে ট্রোলিং করেছে তা নয় বরং বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বিবৃতির দ্বারা জানিয়েছে তারা এই গবেষনাপত্রের সঙ্গে যুক্ত নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালন সমিতি (যা মূলত এই বিশ্ববিদ্যালয়ের দাতাদের নিয়ে গঠিত) এই গবেষণাপত্রের কিছু অংশ পরিবর্তন করার পরামর্শও দেন। এরপর ওই শিক্ষাবিদ পদত্যাগ করেন। কিন্তু তাঁর বিভাগ, তাঁর পুনর্বহালের দাবী জানিয়ে এই সামগ্রিক ঘটনার প্রতিবাদ জানান।
একদল ব্যবসায়ী, যারা মূলত এই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে টাকা দান করেন, তারা একটা গবেষণামূলক নিবন্ধ বিচার করার জন্য আলোচনায় বসেছেন এ শোনা যায় না কখনো। এটা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ও তার অনুদানকারীদের কাছেও অবগত যে তারা এবিষয়ে হস্তক্ষেপ করতে পারেন না। কিন্তু তারা শিক্ষাবিষয়ক প্রশ্নে হস্তক্ষেপ করেছেন একমাত্র বিজেপির ভয়ে।যেকোনো রকম সমালোচনার প্রতি কেন্দ্রীয় সরকারের বিদ্বেষ আছে, তা সে একাডেমিক পেপারই হোক না কেন এবং তাই এই ধরণের বিদ্বেষ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ থেকে শুরু করে তার পরিচালন সমিতি এবং বিভিন্ন বিভাগীয় অধ্যাপকদের সকলের দ্বারাই ক্রমান্বয়ে প্রতিফলিত হয়েছে।
স্পষ্টতই কোনো নামী বিশ্ববিদ্যালয়ই এই শর্তে এই অবস্থায় কাজ করতে পারেনা। এখন যদি কোনো গবেষণাপত্র ভারতের দারিদ্র নিয়ে কথা বলে, যা একটি নির্দিষ্ট সময়কালে বেড়েছে এবং সেই সময়কাল এবং বিজেপির শাসনকাল যদি সমাপতিত হয় তখন সেই গবেষককে প্রভূত নিন্দা সহ্য করতে হবে এবং পরিশেষে তার লেখা পরিবর্তন করতে বলা হবে। যদি কোনো গবেষণাপত্রে লেখা হয় যে, গ্রামীন ভারতে মাথা পিছু আয় কৃষি সঙ্কটের জন্য কমেছে এবং সেই সময়কালটা যদি বিজেপির শাসনকালের সাথে এক হয় তাহলে সেই গবেষণাপত্রও সরকারের ইচ্ছানুযায়ী বদলাতে হবে। এই পরিস্থিতিতে গবেষণার কাজ আর বিজেপির সাফল্য প্রচার করা সমার্থক শব্দ। কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষাকাঠামো গবেষণার উপর অনেকাংশে নির্ভর করে, যেহেতু গবেষণা ব্যাহত হলে শিক্ষার কাঠামো ব্যাহত হবে, স্বাভাবিক ভাবেই সেই বিশ্ববিদ্যালয়টি ধ্বংস হবে।
অনেকে এটাকে অতিকথন ভাবতেই পারে যে, সব বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে দাতারা ,বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার উপর প্রভাব ফেলে ( যদিও এদের মধ্যে সঠিক দায়িত্ব বন্টন করা প্রায়শই কঠিন)। তারা নিয়োগ প্রক্রিয়া কে প্রভাবিত করে।
উত্তর আমেরিকার বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে পুরানো দিনে ইহুদি বংশোদ্ভূত শিক্ষাবিদদের প্রতি প্রায়ই বৈষম্য করা হত; আজকাল কোনো শিক্ষাবিদের প্যালেস্টাইনের প্রতি সহমর্মিতা তাকে অসুবিধার মধ্যে ফেলে। মার্কসবাদীরা অবশ্যই সবসময় বৈষম্যের শিকার হন, এতটাই যে পল সুইজি কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিজিটিং প্রফেসর হিসাবে আমন্ত্রণ গ্রহণ করা বন্ধ করে দিয়েছিলেন কারণ তিনি শুনেছিলেন যে তার ভিজিটিং সময়কালের জন্য অনেক তরুণ মার্কসবাদী শিক্ষাবিদ যারা অস্থায়ী শিক্ষক হিসাবে কাজ করার জন্য আগে নিয়োজিত হয়েছেন, তাদের মেয়াদ অস্বীকার করার অজুহাত হিসাবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
যাই হোক, অনুদানকারীদের অর্থ সাহায্যে পরিচালিত বা সরকারী কর্তৃপক্ষ দ্বারা পরিচালিত বিদেশের অনেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে নিপীড়ন ও বৈষম্যের ঘটনা আগে দেখা গেলেও ভারতের ক্ষেত্রে এই প্রথম। এই ক্ষেত্রে অবশ্য দুটি মূল পার্থক্য আছে। প্রথমত, বৈষম্য বা নিপীড়নের এই ধরনের সব ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের পদক্ষেপের পেছনে সরকারি হস্তক্ষেপ বা হুমকির কোন প্রমাণ সরাসরি পাওয়া অসম্ভব। এইগুলিকে মূলত অর্থ অনুদানকারীদের শাসকের প্রতি পক্ষপাত হিসাবে দেখানো যেতে পারে কিন্তু কোনো সরাসরি রাজনৈতিক অবস্থান দেখানো হয়না। দ্বিতীয়ত, বিদেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে বৈষম্য ও নিপীড়নের ঘটনায় এটা দেখা যায় না যে কোন দাতা বা কর্তৃপক্ষ মিলিতভাবে একটি একাডেমিক গবেষণাপত্রের “তদন্ত” করে এবং এর লেখককে তা পরিবর্তন করতে বলে। গবেষণাপত্রগুলি বিশেষজ্ঞদের দ্বারা পর্যালোচনা করা হয় ( peer – reviewed) এবং প্রকাশনার জন্য সম্পূর্ণ স্বাধীন পথ অনুসরণ করে, যেখানে অবশ্যই তাদের বিষয়বস্তু পরিবর্তন করার জন্য স্পষ্ট বা অন্তর্নিহিত হস্তক্ষেপ থাকতে পারে; কিন্তু এর সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বা দাতাদের কোনো সম্পর্ক নেই। অশোক বিশ্ববিদ্যালয়ে যা ঘটেছে তা অত্যন্ত অস্বাভাবিক; যার দ্বারা এটাই স্পষ্ট হয় যে আসলে ভারতকে ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রে পরিণত করার দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, এমন রাষ্ট্র যে নিজের বিরূদ্ধে হওয়া কোনো সমালোচনাকেই, এমনকি বৌদ্ধিক চর্চা বা গবেষণার ক্ষেত্রেও, সহ্য করতে পারছেনা।
এর ফলে সমাজবিজ্ঞানের সকল গবেষণাই বাতিল হয়ে যায়। যদি তারা সমাজের সাথে ঘটে যাওয়া ঘটনা, সরকারের গঠন, সরকারের কার্যকলাপ ইত্যাদি সম্পর্কে গবেষণা না করতে পারেন সঠিকভাবে, যদি সমাজবিজ্ঞানের নিজস্ব পদ্ধতি অবলম্বন করে কোন সত্যের দিকে এগোতে না পারেন তাহলে সমাজবিজ্ঞানে গবেষণা অসম্ভব। অবশেষে তা প্রাকৃতিক বিজ্ঞানকেও প্রভাবিত করবে। কোনো গবেষণা যদি হিন্দুত্ব কুসংস্কারকে প্রশ্ন করে তাহলে সেই লেখাকেও বদল করতে বলা হবে। ফলত বিশ্ববিদ্যালয়গুলি অস্তিত্বজনিত সংকট এর মধ্যে পরবে এবং তা সাধারণ কোচিং সেন্টারে পরিনত হবে।
আত্মনির্ভর ভারতের কথা বলে মোদি সরকার চারদিকে যে ঢোল পিটাচ্ছে তা এইভাবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলি ধ্বংস হলে কখনোই বাস্তবায়িত হবে না।
(গত ২৭ অগাস্ট ২০২৩ ‘পিপলস ডেমোক্র্যাসি’ পত্রিকায় ‘The Destruction of Universities’ শিরোনামে প্রকাশিত প্রবন্ধটির বঙ্গানুবাদ )
ভাষান্তর : দিধীতি রায়