Site icon CPI(M)

চট্টগ্রাম সশস্ত্র অভ্যুত্থানের সর্বাধিনায়ক :কলতান দাশগুপ্ত

১২ জানুয়ারী ২০২৩

১৮৯৪ সালের ২২শে মার্চ বাংলাদেশের চট্টগ্রাম জেলার কর্ণফুলী নদীর তীরে নয়াপড়া গ্রামে সেন পরিবারে জন্ম। রাজমণি সেন ও শশীবালা সেনের চতুর্থ সন্তান সূর্য সেন । পা‍‌শের গ্রামের বিশ্বেশ্বরী পাঠশালায় তার পড়াশুনা শুরু, তারপর নয়াগ্রাম উচ্চবিদ্যালয়। পড়াশুনায় তিনি খুবই ভালো ছিলেন।

১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ। মুহুর্তের মধ্যে বাংলার চারিদিকে আগুন জ্বলে উঠলো । প্রতিবাদ, বিক্ষোভ, রাখিবন্ধন, অরন্ধন, বিদেশী দ্রব্য বয়কট — সংগ্রামের নতুন নতুন তরঙ্গ সৃষ্টি হলো। মাস্টারদা এই প্রথম কোনও আন্দোলনে যোগ দিলেন।

এরপর গ্রাম ছেড়ে চট্টগ্রাম শহরে পড়তে আসেন। চট্টগ্রাম ন্যাশনাল ইনস্টিটিশনে ভর্তি হন। ১৯১২ সালে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় ফার্স্ট ডিভিসনে পাস করেন। ১৯১৪ সালে চট্টগ্রাম কলেজ থেকে আই এ পাস করেন। কলেজে পড়াকালীন স্বাধীনতা সংগ্রামের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের সাথে যুক্ত হয়েছিলেন।চট্টগ্রাম কলেজ থেকে তাকে বদলী করে দেওয়া হয় বহরমপুরের কৃষ্ণনাথ কলেজে। এখানে তিনি বিপ্লবী দল যুগান্তরের সাথে যুক্ত হয়েছিলেন।

১৯১৮ সালে বি.এ পরীক্ষায় পাস করে চট্টগ্রামে উমাতারা উচ্চবিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসাবে যুক্ত হন সূর্য সেন। কিছু দিনের মধ্যে বিপ্লবী আদর্শ নিয়ে তৈরি করেন ‘‘ছাত্র সমিতি’’। ছাত্র সমিতির কাজের মধ্যে দিয়ে শিক্ষক সূর্য সেন হয়ে উঠলেন মাস্টার দা। ১৯১৯ সালে জালিয়ানওয়ালবাগের কাণ্ডের পর গণ আন্দোলনের উত্তাল ঢেউ ; মাস্টারদার নেতৃত্বে শুরু হলো নতুন অভিযান। ১৯২০ সালে বিপ্লবী ছাত্র যুব সংগঠন সাম্যশ্রম তৈরী হল

১৯২১ সালে কংগ্রেস গ্রহণ করলো অসহযোগ আন্দোলন। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ-এর আহ্বান ‘‘Education may wait, but the struggle for freedom can not’’ । মাস্টারদার নেতৃত্বে ছাত্ররাও যোগ দিলো অসহযোগ আন্দোলনে। সারা দেশের ছাত্র-যুব, মহিলা, কৃষক, শ্রমিক সকলেই একে একে অংশগ্রহণ করছিল।

মাস্টারদা সূর্যসেন Dan Breen – এর লেখা My Fight For Irish Freedom বহুবার অধ্যয়ন করেছেন। চট্টগ্রাম সশস্ত্র অভ্যুত্থানের সাথীদের কেও এই বই পড়ার জন্য উৎসাহিত করতেন। Dan Breen ছিলেন মাস্টারদার আদর্শ। আয়ারল্যান্ডের অনুসরণেই তৈরি হয়েছিল ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মি, চট্টগ্রাম শাখা। মাস্টারদা ছিলেন তার প্রেসিডেন্ট। অম্বিকা চক্রবর্তী, নির্মল সেন, অনন্ত সিং, গণেশ ঘোষরা হলেন অন্যতম সদস্য। সংগঠনের সংবিধান গ্রহণের পর আলোচনা চলছিল শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান নিয়ে। গীতা ছুঁয়ে শপথ, বুক চিরে মা কালীকে রক্ত দেওয়া, এই সব প্রস্তাব আসছিল, মাস্টারদা জানালেন — ‘‘বিশেষ ধর্মে আমরা অনেকেই বিশ্বাস করি ঠিকই, কিন্তু এই সংগ্রাম সবার। ধর্মের কোনো ভেদ নেই — তাই কোনো ধর্মের বিশেষ অনুষ্ঠানকে আমরা গ্রহণ করতে পারি না। ধর্মীয় অনুষ্ঠান বর্জনের সিদ্ধান্ত সেদিন সকলেই নিয়েছিলেন। দেশমাতৃকার স্বাধীনতা যেখানে শপথ সেখানে শপথ গ্রহণের অনুষ্ঠানের কি প্রয়োজন? তিনি বলতেন ফাঁসিতে যাওয়া বা নিছক আত্মদান আমাদের আদর্শ নয় ;আমাদের আদর্শ স্বাধীনতা। কিন্তু মুষ্টিমেয় আমরা, আমাদের কয়েকজনের প্রচেষ্টাতেই স্বাধীনতা আসবেনা। তার প্রতি প্রচেষ্টা ও তার সাফল্য আমাদের মধ্যে বেশী করে জনসাধারণকে নিয়ে আসবে। আমাদের সাফল্য, জনসাধারণের মধ্যে আত্মবিশ্বাস তৈরি করবে; আমাদের আত্মদানের মূল্য এইখানে। একটা পর্যায় পর্যন্ত সশস্ত্র সংগ্রামের গোপন দলে মহিলাদের অংশগ্রহণ চাননি সূর্য সেন। আবার তিনিই সময়ের প্রয়োজন বুঝে লড়াইয়ের সামনের সারিতে দায়িত্ব দিয়েছিলেন প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার, কল্পনা দত্তদের।

কল্পনা দত্ত
প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদা

লড়াই করতেন শিকড়ে থেকে।শরৎ বসু বার্তা পাঠিয়েছিলেন, “তোমাকে দেশের দরকার। চলে এসো।” গা ঢাকা দিয়ে পালিয়ে বেড়াতে বেড়াতে শীর্ণকায় লোকটি জবাব পাঠিয়েছিলেন, “লড়াইয়ের মাটি চট্টগ্রাম থেকে আমি কোথাও যাবো না।” লড়াই আন্দোলনের জন্য প্রচুর অর্থের প্রয়োজন হতো। মাস্টারদা কখনোই অর্থ সংগ্রহের জন্য রাজনৈতিক ডাকাতিতে বিশ্বাস করতেন না। তার ভাবনা ছিল দু-চারটি ডাকাতিতে স্বাধীনতা লাভ তো হবেই না, অথচ আসল উদ্দেশ্য পন্ড হবে। চট্টগ্রাম সশস্ত্র অভ্যুত্থানের আগে পরিকল্পনামাফিক দেখা গিয়েছিল যে অন্তত ১৫,০০০ টাকা দরকার। সেই সময় প্রত্যক্ষভাবে লড়াই আন্দোলনে জড়িয়ে পড়া এবং দেশের জন্য প্রাণ দেওয়ার জন্য আগুয়ান মানুষের সংখ্যা প্রচুর ছিল। মাস্টারদা জানালেন, যে সবচেয়ে বেশি টাকা দেবে তার কাজে যাওয়ার দাবি সর্বাগ্রে থাকবে। সবাই সবার সাধ্যমত সাহায্য করলো। কিছুদিন পর একটি ছেলে এসে মাস্টারদার সামনে কান্নায় ভেঙে পড়ল। তার বাড়িতে সাহায্য করার মত কিছুই ছিল না। মায়ের শেষ সম্বল একটি রুপোর গয়না সে নিয়ে এসে মাস্টারদা কে দেয়। মাস্টারদা জানিয়েছিলেন কাজে যাওয়ার তালিকায় এই ছেলেটির নাম সর্বাগ্রে থাকবে।

যেকোনো পরিস্থিতিতে ধীর-স্থির এবং কর্তব্যে দৃঢ় থাকতে পারতেন। ১৯৩২ সালের জুন মাসে ধলঘাট গ্রামের একটি বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলেন তিনি । তার সাথে দেখা করতে গিয়েছিলেন প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার। কোনভাবে পুলিশ খবর পেয়ে বাড়ি ঘেরাও করে ফেলে। দু’পক্ষের যুদ্ধের কিছুক্ষণ পরে মাস্টারদার সাথী গুরুতর আহত হন। আবেগপ্রবণ প্রীতিলতা আহত সাথীকে ফেলে যেতে চাননি, কিন্তু মাস্টারদা কর্তব্যে অবিচল। মৃত্যুপথযাত্রী, দীর্ঘদিনের সাথী নির্মল সেনকে ছেড়ে যেতে মন না চাইলেও প্রীতিলতাকে সঙ্গে নিয়ে চলে আসেন কারণ, প্রীতিলতার উপরে আরো অনেক দায়িত্ব অর্পিত ছিল। মাস্টারদা, তারকেশ্বর দস্তিদার এবং কল্পনা দত্ত শীতের রাতে এক বয়স্কা মহিলার বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলেন। তীব্র ক্লান্তিতে আচ্ছন্ন হয়ে পড়া সত্বেও দরজায় ধাক্কা ও আশ্রয়দাত্রী বয়স্কা মহিলার কান্না শুনে মাস্টারদা সতর্ক হয়ে ওঠেন। বিপদকে সহজে গ্রহণ করে, মাথা ঠান্ডা রেখে সেই যাত্রায় পালিয়ে যেতে সক্ষম হন তারা সকলে।

মাস্টারদা সম্পর্কে নানা কথা চালু ছিল। কিভাবে তিনি বয়স্ক মালি সেজে পুলিশের বেড়াজালের মাঝখান দিয়ে পালিয়ে গেলেন, কিভাবে সন্ন্যাসী সেজে গ্রামের মানুষ বা পুলিশেরই লোকের সাথে কথা বলতে বলতে গ্রামের পর গ্রাম অতিক্রম করে গেলেন এইরকম অনেক কথা প্রচলিত ছিল। ব্রিটিশ পুলিশ নানাভাবে জনসাধারণের ওপর অত্যাচার চালাত মাস্টারদা সম্পর্কিত খবরের জন্য। কিন্তু কেউ কোনদিনও চাননি যে মাস্টারদা বা তার দলের ছেলেরা ধরা পড়ুক, বরং অনেক ক্ষেত্রে মাষ্টারদাকে বাঁচানোর ক্ষেত্রে সাহায্য সহযোগিতাও হয়েছে ব্যাপকভাবে। একবার পটিয়া গ্রামে মাস্টারদা ও তার সাথীদের গ্রেপ্তারের জন্য সৈন্য এসেছে। রাতের অন্ধকারে একটা বাড়ি তারা ঘিরে ফেলে। গৃহকর্তাকে জিজ্ঞেস করা হয়,

চট্টগ্রাম সশস্ত্র অভ্যুত্থান বা চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহের দিন ঘোষণা হলো ১৮ই এপ্রিল ১৯৩০। নির্ধারিত হল এই কটি লক্ষ্য ঃ
(১) পুলিসের অস্ত্রাগার দখল, (২) অক্সিলিয়ারি ফোর্সের অস্ত্রাগার দখল, (৩) টেলিফোন ও টেলিগ্রাম ধ্বংস করা, (৪) ইউরোপীয়ান ক্লাব আক্রমণ, (৫) চট্টগ্রামের রেল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করা, (৬) বিদ্রোহের সংবাদ প্রচারের ব্যবস্থা করা। কেবল ইউরোপীয়ান ক্লাব বন্ধ থাকার কারণে রক্ষা পেলো, বাকি সমস্ত কর্মসূচি পরিকল্পনা অনুযায়ী সফল হলো। ইউনিয়ন জ্যাক পুড়িয়ে ফেলার পর সমস্বরে চিৎকার ‘সাম্রাজ্যবাদ ধ্বংস হোক,’ ‘বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক,’ ‘বন্দেমাতরম।’এইসব আন্দোলন কেবল চট্টগ্রাম না সারা ভারতজুড়ে এক বিশেষ বিপ্লবী আদর্শ তৈরি করেছিল। সারা ভারতে তরঙ্গ প্রবাহিত হয়েছিল।

১৯৩৩ সালের ১৬ই ফেব্রুয়ারি মাস্টারদা গ্রেপ্তার হন। যে বাড়িতে আত্মগোপনে ছিলেন, তার পাশের ঘরের ভদ্রলোক নিজের স্ত্রীর থেকে শোনেন যে মাস্টারদা এখানে আছেন। আশ্রয়স্থলের খবর পুলিশকে দিয়ে দেন। বিশ্বাসঘাতক বেশী দিন বাঁচেননি। কয়েকদিন পর রাতে খেতে বসার সময়ে মাস্টারদার এক সাথী তাকে ছুরি মেরে খুন করেন স্ত্রীর সামনেই। পুলিশের ব্যাপক চাপ সত্ত্বেও সেই ভদ্রমহিলা সারাজীবনে একবারও আততায়ীর নাম প্রকাশ করেননি। ১৯৩৩ সালে ১৪ই আগস্ট মাস্টারদার ফাঁসির হুকুম হয়। ১৯৩৪ সালের ১২ই জানুয়ারি ফাঁসি হয়। সাধারণ নিয়মের ব্যতিক্রম করে রাত ১২টার কিছু পরে তাঁকে ফাঁসি দেয় ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের কর্তারা। মৃতদেহ আত্মীয়স্বজনদেরও দেওয়া হয়নি। তাদের ধারণা ছিল জীবন্ত মাস্টারদার থেকেও শহীদ মাস্টারদা আরো বেশি ভয়ংকর হবেন। মৃত শরীরে পাথর বেঁধে সমুদ্রে ভাসিয়ে দেওয়া হয়।

নিজের শেষ আহ্বান লিখেছিলেন ১৯৩৪ সালের ১১ জানুয়ারী ৷ ফাঁসির কয়েকঘন্টা আগে লিখলেন,” আমাদের সংগঠনে বিভেদ না আসে—এই আমার একান্ত আবেদন। যারা কারাগারের ভেতরে ও বাইরে রয়েছে, তাদের সকলকে জানাই আমার আশীর্বাদ। বিদায় নিলাম তোমাদের থেকে।” সেই বার্তা শেষ করেছিলেন দুটি স্লোগান দিয়ে। প্রথমে লিখেছিলেন ‘বিপ্লব দীর্ঘজীবি হোক।’ তারপর ‘বন্দেমাতরম।’

Spread the word