৮ জুলাই ২০২২ (শুক্রবার)
দ্বিতীয় পর্ব
৩
তার পরে যাদবপুরে শিক্ষক সংগঠন জুটাতে কাজ করবার সময় তাঁর সঙ্গে যে খুব যোগাযোগ হয়েছে তা মনে পড়ে না। ষাটের বছরগুলিতে যুক্তফ্রন্টের ক্ষমতায় আসা, বাংলা কংগ্রেসের বিশ্বাসঘাতকতা, কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী)র নেতাদের জেলবন্ধন আর পুলিশের পশ্চাদ্ধাবন এড়িয়ে চলার পর্ব দেখেছি, কমরেড সরোজ মুখোপাধ্যায় তো আমারই পার্কসার্কাসের বেনিয়াপুকুরের বাসায় কিছুদিন গোপনে থেকে গেছেন। ক-বছর পরে ফুলব্রাইট বৃত্তি পেয়ে বিদেশেও চলে যেতে হল ভাষাবিজ্ঞানে গবেষণা করার জন্য, শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া আর কাজ শুরু হল ১৯৬৯ থেকে। ফিরে এলাম দীর্ঘ ছ-বছরের বেশি সময় কাটিয়ে, আবার যাদবপুরে থিতু হলাম। এই সময়ে ইন্দিরা গান্ধীর স্বৈরতন্ত্রকে ১৯৭৭এর সাধারণ নির্বাচনে ভারতীয় নাগরিকেরা উৎখাত করেছে, পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্ট সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তখন আমার ছাত্র-আন্দোলনের অনুজপ্রতিম কর্মীরা, কমরেড বিমান বসু আর বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য আমাকে ডেকে নিলেন সরকারের নানা কাজে।
প্রথমেই সেই প্রাথমিকে ইংরেজি নিয়ে বিতর্ক। যেটা বলা দরকার, এবং এখনকার সমালোচকেরা প্রাণপণে অস্বীকার করার চেষ্টা করে, তা হল প্রাথমিকের প্রথম কয়েকটা ক্লাসে ইংরেজি না পড়ানোর প্রস্তাব বামফ্রন্টের নিজস্ব উদ্ভাবন নয়, স্বাধীনতার পর সমস্ত ভারতীয় শিক্ষা কমিটি ও কমিশন এই সুপারিশ করেছিল, কোঠারি কমিশন পর্যন্ত। পশ্চিমবাংলাতেও সিদ্ধার্থ রায়ের সরকারের নিযুক্ত হিমাংশুবিমল মজুমদার কমিটি এই সুপারিশ করেছিল। সিদ্ধার্থ রায় সে সুপারিশ চেপে রেখেছিলেন, তার পরে তো তাঁর দল হেরেই গেল। বামফ্রন্ট ওই বিজ্ঞানসম্মত সুপারিশকে ধুলোটুলো ঝেড়ে কাজে লাগানোর চেষ্টা করতেই মধ্যবিত্ত উচ্চাকাঙ্ক্ষী বাঙালি হইহই করে উঠল, মিছিল, প্রতিবাদ সব হতে লাগল। জ্যোতিবাবুর সরকারকে এই ঝড় সইতে হয়েছিল।
তাঁর সঙ্গে আমার প্রথম মুখোমুখি কথা হয় ১৯৯০এর মার্চে, রবীন্দ্র ভারতীতে আমার উপাচার্য নির্বাচন হওয়ার পরে। তিনি তখন উচ্চশিক্ষামন্ত্রী, ফলে কর্তব্যবোধে তাঁর সঙ্গে গিয়ে একদিন মহাকরণে দেখা করি, অনুমোদিত সময়ে। তিনি বুদ্ধদেব প্রভৃতির কাছে আমার সম্বন্ধে খুঁটিনাটি জেনেছেন, সেটা তাঁর সঙ্গে কথাবার্তার সূত্রে জানা গেল। আর দেখলাম রবীন্দ্র ভারতীর সমস্যাও তাঁর নখদর্পণে। দীর্ঘদিন সেখানে অচলাবস্থা চলেছে, আগেকার উপাচার্য গান্ধিজির মূর্তির নীচে অনশনে পর্যন্ত বসেছেন। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের দীর্ঘস্থায়ী নানা ব্যাধির নিরাময়ের জন্য তাঁরা নতুন মুখ খুঁজেছেন, সদিচ্ছা নিয়েই। তিনি বললেন কীভাবে ধাপে ধাপে আমাকে এগিয়ে যেতে হবে, সরকারের সব রকম সহযোগিতার আশ্বাস দিলেন। আমাকে বসিয়ে কাজুবাদাম আর কফির আপ্যায়নের মধ্যেই স্নেহস্পদ অসীম দাশগুপ্তকে ডেকে এনে বললেন, ‘দ্যাখো, এঁরা মানী মানুষ, এদের যেন বিশ্ববিদ্যালয়ের হয়ে দরবার করতে বারবার রাইটার্সে এসে জুতোর শুকতলা না খুইয়ে ফেলতে হয়।’ এই কথা আমার চিরজীবনের সঞ্চয় হয়ে আছে। অসীমও সে কথা মনে রেখেছিলেন।
১৯৯১ সালে অশোক মিত্রের শিক্ষা কমিশনের সদস্য হলাম, সেই কমিশনের রিপোর্ট তাঁর হাতে তুলে দিতে মহাকরণে গিয়েছিলাম মনে আছে। তিনি সন্তোষ প্রকাশ করেছিলেন রিপোর্ট অত তাড়াতাড়ি তৈরি হওয়ায়। অশোকদা অবশ্য খুব দ্রুত কাজ করতেন, সভা করে, নানা জায়গায় গিয়ে, সকলের মতামত জেনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ডিক্টেশন দিতেন। তবে এই বছরগুলিতে জ্যোতিবাবুর সঙ্গে আমার একটু ঘন ঘন দেখা হতে লাগল। এক রবীন্দ্র ভারতীতে ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলির উপাচার্যদের সম্মেলন হল, তিনি উদ্বোধক। সেটা বোধ হয় ১৯৯৪ সালে। তারপর ওই ১৯৯১ থেকেই পশ্চিমবঙ্গে নানা জেলায় সাক্ষরতার কাজকর্ম চলছে, দক্ষিণবঙ্গের ন-টি জেলার সাক্ষরতার মূল্যায়ন সমিতির সভাপতি আমি। সকলেই মূল্যায়ন শেষ হলে তার প্রতিবেদন (‘পূর্ণ সাক্ষরতা’য় পৌঁছানোর) একটা বড় জনসভা করে জ্যোতিবাবুর হাতে জমা দিতে চায়। সব জেলা সেটা পেরে ওঠেনি অবশ্য, কিন্তু উত্তর চব্বিশ পরগনার বারাসতে একটা বিশাল সভা হয়েছিল, তাতে জ্যোতিবাবুর পাশে আমি বসার দুর্মূল্য সুযোগ পেয়েছিলাম।
একটি বিচিত্র অভিজ্ঞতার কথা বলি। হয়তো একটু আত্মপ্রচার করা হবে। শ্রীমান বিমান বসুর সাক্ষরতা প্রসার সমিতির নানা কাজের সঙ্গে আমি যুক্ত। একবার বিদ্যাসাগর মেলা হল কলকাতার ভিক্টোরিয়া মেমোরিযাল সংলগ্ন মাঠে, তার উদ্বোধন করলেন জ্যোতিবাবু। যার উদ্বোধন সংগীত করার কথা সে এসে পৌঁছোয়নি, বিমান একটু আথান্তরে পড়েছে। সে সম্ভবত ছাত্রজীবন থেকে জানত যে আমি পথেঘাটে চেঁচিয়ে গান করি, এই বুড়ো বয়সেও সে অভ্যাস ছাড়িনি, লোকলজ্জার ভয় করি না। তাই সে আমাকে গিয়ে ধরল, পবিত্রদা, উদ্বোধন সংগীতটা গেয়ে দিতে হবে। আমি আর কী করি, পোডিয়ামে গিয়ে রবীন্দ্রনাথের ‘এখন আর দেরি নয়’টা গেয়ে দিলাম। গেয়ে সিটে বসতে যাব, জ্যোতিবাবু হাত নেড়ে ডাকলেন। সসংকোচে কাছে গেলাম। বললেন, ‘আপনার যে এ গুণ আছে তা তো জানতাম না।’ বলে প্রশংসাসূচক আরও দুএকটি কথা বললেন। আমি কানের গোড়া লাল করে ফিরে এলাম। কিন্তু মনে দারুণ খুশি, আমার সারাজীবনের চ্যাঁচানির প্রেরণা পেয়ে গেলাম বলা যায়।
১৯৯৮তে তাঁর কাছ থেকে জীবনের সবচেয়ে বড় দায়িত্ব পেলাম। সবাই জানে যে, ১৯৮৪ থেকে পশ্চিমবাংলার প্রাথমিক স্কুলগুলিতে ক্লাস সিক্স থেকে ইংরেজি পড়ানোর শুরু একশ্রেণির অভিভাবককে খুশি করা যায়নি। একটি রাজনৈতিক দল তাদের সংগঠিত করে পথে-ঘাটে মিছিল করতে শুরু করে, এবং ক্লাস ওয়ান থেকে ইংরেজি পড়ানো শুরু করার জন্য আন্দোলনও চালাতে থাকে। এই বিষয়টার রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া জ্যোতিবাবুকে কিছুটা উদ্বিগ্ন করেছিল বলে মনে হয়, তিনি ১৯৯১তে শিক্ষা কমিশনে অশোকদাকেও এ কথাটা ভাবতে বলেন। অশোকদা খুব একটা পরিবর্তনে রাজি ছিলেন না— তিনি নিজে তুখোড় ইংরেজি বলতেন, লিখতেন— কিন্তু আমারই মতো ভাবতেন যা হয়েছে ঠিকই হয়েছে। তবু তাঁর কমিশনে ইংরেজি পড়ানো শুরু এক বছর এগিয়ে আনা হল।
তাতেও শোরগোল থামল না। ফলে, ১৯৯৮ সালে জ্যোতিবাবু আমাকে ডাকলেন বিষয়টি পুনর্বিবেচনার জন্য একটি কমিটি করে, যার নাম One-Man Committee for Teaching English at the Primary Level in West Bengal Schools. আমি পশ্চিমবঙ্গের তখনকার সতেরোটি জেলায় ঘুরে, শতাধিক প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষক আর অভিভাবকদের, আর নানা শিক্ষক সংগঠন আর সমাজবিজ্ঞানী আর ভাষাবিজ্ঞানীদের সঙ্গে কথা বলে সেপ্টেম্বরে একটি রিপোর্ট তাঁর হাতে জমা দিলাম, যাতে ক্লাস থ্রি থেকে ইংরেজি পড়ানো শুরু করার সুপারিশ ছিল। বর্ণমালা ক্লাস টু-র মাঝামাঝি থেকে চেনানোর সুপারিশ সহ। এই সুপারিশ জ্যোতিবাবুকে খুশি করেছিল মনে হয়।
এই তাঁর সঙ্গে আমার শেষ প্রাতিষ্ঠানিক যোগাযোগ। পরে ২০০০ সালে আমার বড় কন্যার বিবাহে ব্যক্তিগতভাবে তাঁকে নিমন্ত্রণ করতে গেছি তাঁর সল্ট লেকের বাসভবনে। তখনও বুঝেছি আমাকে তিনি স্নেহ করেন। বিয়েতে আসতে পারেননি, কিন্তু বিশাল এক ফুলের তোড়া পাঠিয়েছিলেন বিয়ের দিন, আশীর্বাদ হিসেবে।
এই শেষ বড় মাপের বাঙালির সঙ্গে আমার শেষ সাক্ষাৎ তাঁর শবযাত্রায়। উপমহাদেশের এই ইতিহাসনির্মাতাকে আমার রক্তিম অভিবাদন। তাঁর অভাব বোধ করতেই থাকব। কিন্তু তাঁর জীবন আর কাজ থেকে প্রেরণা নিতে যেন না ভুলি।