Site icon CPI(M)

Indian Freedom Struggle And RSS – A Retrospective (Part-7)

ভারতের জাতীয় আন্দোলন ও আর এস এস – (সপ্তম পর্ব)

ধারাবাহিক রচনাঃ গৌতম রায়

আরএসএস নিজেদের রাজনৈতিক দর্শন ও কর্মসূচি ‘  সাম্প্রদায়িকতা’কে প্রসারিত করার লক্ষ্যে ,হেডগেওয়ারের  শৈশব-কৈশোরের জীবনের বীরত্ব বর্ণনার পরই চলে আসে একেবারে হেডগেওয়ারের কলকাতা মেডিকেল কলেজের ছাত্র হিসেবে অধ্যয়নের সময়ের  গন্ডাতে।               

কিন্তু মজার কথা হল; ইংল্যান্ডেশ্বরী  ভিক্টোরিয়া র সিংহাসন আরোহণের ষোড়শ বর্ষপূর্তির  সময়কালে, গোটা বোম্বাই প্রেসিডেন্সি জুড়ে বাল গঙ্গাধর তিলকের নেতৃত্বে যে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী আন্দোলন শুরু হয়েছিল, সেই আন্দোলন সম্পর্কে শৈশব -কৈশোরে হেডগেওয়ারের  মানসিক দৃষ্টিভঙ্গি কি ছিল,  বা বিন্দুমাত্র সাযুজ্য ছিল কি না, সেই আন্দোলনের সঙ্গে এতোটুকু  সম্পর্ক ছিল কি না, সখ্যতা ছিল কি না— সেই  প্রশ্নে আরএসএস সম্পূর্ণ নীরবতা পালন করে যায়।
             

ব্রিটিশ শক্তির বিরুদ্ধে নিজেদের লড়াইয়ের মনগড়া ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে হেডগেওয়ার কে ব্যবহার করলেও, হেডগেওয়ারের  শৈশবকালে গোটা বোম্বাই প্রেসিডেন্সি জুড়ে চিদপাবন   ব্রাহ্মণ তিলকের( হেডগেওয়ার নিজেও যে সম্প্রদায়ের ব্রাহ্মণ ছিলেন)  নেতৃত্বে স্বদেশী আন্দোলন এবং সশস্ত্র প্রতিরোধ এবং  সেই প্রতিরোধের ভেতর কিছুটা হিন্দু পুনরুত্থাণবাদী   চিন্তা ভাবনা থাকলেও ,সেই সব কোনো ভাবনার সঙ্গে, আরএসএসের প্রধান প্রতিষ্ঠাতা হেডগেওয়ারের যে বিন্দুমাত্র সম্পর্ক ছিল না– একথা খুব স্পষ্ট ভাবেই বলা যায়।
               

যে শিবাজী র বীরত্ব আর মুসলিম বিদ্বেষ কে একাত্ম করে দিয়ে, আরএসএস নিজেদের তথাকথিত সাম্রাজ্যবাদবিরোধী মানসিকতার একটা ছদ্ম আবরণ দেখাতে চায় ,সেই শিবাজী সম্পর্কে ১৮৯৭ সালের ১৫ ই  জুন বালগঙ্গাধর তিলক তাঁর ‘ কেশরী’  পত্রিকাতে লিখছেন ;
             ” আফজাল খাঁর হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে ঐতিহাসিক সংবাদ সংগ্রহের প্রয়োজন নেই ,একথা ধরে নিয়ে ই  এখন এগোনো যাক।শিবাজি পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী আফজাল খাঁকে হত্যা করেছিলেন ।তাঁর এই কাজ ,ভাল না মন্দ- তার মীমাংসার জন্য পেনাল কোডের বিধি-বিধান অনুযায়ী আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে না।
                 তাঁর সেই কাজের বিচারের জন্য আমাদের প্রাচ্যদেশ বা  পাশ্চাত্য সভ্যতার অন্য নীতিশাস্ত্রের সাহায্য নেওয়ার বিন্দুমাত্র প্রয়োজন আমি মনে করি না ।আমাদের মতন অতি সাধারণ মানুষদের জন্যই রচিত হয়েছে শাস্ত্রবিধি। তা না হলে ঋষিদের পারিবারিক ইতিহাস নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না ,অথবা কেউ রাজার বিশেষ কাজের জন্য সেই রাজার উপরে অপরাধের দোষ পর্যন্ত চাপিয়ে দেয় না ।
               বিরাট মানুষেরা সাধারণ স্বাস্থ্যবিধির ঊর্ধ্বে ।তাঁরা যে স্তরে বাস করেন ,সেখানে এইসব শাস্ত্রের নিয়ম পৌঁছতে পারেনা ।আফজাল খাঁ কে মেরে শিবাজী কি অন্যায় করেছিলেন? এই প্রশ্নের উত্তর মহাভারতের দেয়া রয়েছে। ভগবত গীতায় শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে তাঁর আত্মীয়-স্বজন ,জ্যেষ্ঠদের পর্যন্ত মারতে পরামর্শ দিয়েছেন ।ফলের আকাঙ্ক্ষা না রেখে কাজ করলে কোন দোষ হয় না।
                 শিবাজী মহারাজ নিজের স্বার্থে কিছু করেননি ।জনকল্যাণের কথা ভেবে  নেয়ার উদ্দেশ্যে তিনি সব কিছু করেছিলেন। কোনো বাড়িতে যদি চোর প্রবেশ করে ,আর তাকে তাড়াবার জন্য যদি বাহুবল না থাকে ,তাহলে চোরকে অবশ্যই ঘরের মধ্যে বন্ধ করে পুড়িয়ে মারা যায় ।এই পরিণামের  এর ভেতরে কোনরকম বিবেক দর্শন কাজ করেনা। সর্বশক্তিমান ঈশ্বর তামার পটে খোদাই করে বিদেশীদের ভারত শাসনের অধিকার দেয়নি।মহারাজ শিবাজী বিদেশীদের নিজের  পিতৃভূমি থেকে তাড়াতে চেয়েছিলেন। তা ছাড়া আর কোনও লাভের ব্যাপার তাঁর ভেতরে ছিল না ।”
            

এই ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি, যার সঙ্গে পরবর্তীকালে আরএসএসের রাজনৈতিক কর্মসূচি ‘সাম্প্রদায়িকতা’র অসম্ভব বেশি রকমের সাযুজ্য আছে ,সেই দৃষ্টিভঙ্গির প্রচার ও প্রসারের কার্যক্রম তিলক করছেন বোম্বাই প্রেসিডেন্সিতে বসে, তখন কিন্তু কোনো অবস্থাতেই সেইসব কর্মকাণ্ডের সঙ্গে শিশু-কিশোর হেডগেওয়ারের   বিন্দুমাত্র সম্পর্কের  কোন ঐতিহাসিক নিদর্শন আমরা পাই না।
              

রানী ভিক্টোরিয়াল  সিংহাসন আরোহণের ষোল বছর পূর্তি উৎসবের যে কল্পকাহিনী হেডগেওয়ারের  বীরত্ব উপস্থাপিত করতে রাজনৈতিক হিন্দু সাম্প্রদায়িক শক্তি উপস্থাপিত করে, তারা কিন্তু একটিবারের জন্য বলে না যে; এই ভিক্টোরিয়া র  জুবলী উৎসব চলাকালীন,  পুনার লাট ভবনে উৎসব শেষ করে ফেরার পথে, পুনার বিশিষ্ট্য ইংরেজ অফিসার মিস্টার রান্ড এবং লেফটেন্যান্ট আয়াস্ট  আততায়ী দ্বারা গুলিবিদ্ধ হওয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে তিলক এবং তাঁর সহকর্মীদের ওপর যে ধরনের অকথ্য অত্যাচার ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শক্তি চালিয়েছিল, সে সম্পর্কে শিশু-কিশোর হেডগেওয়ারের  বিন্দুমাত্র কোন ধারণাই ছিল না ।
               

হেডগেওয়ার যদি সত্যিই স্বদেশী আন্দোলনের সঙ্গে তার শিশু কিশোর বয়স কালে সংযুক্ত থাকতেন,  তাহলে এই দুজন ইংরেজ , স্বদেশী আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত, সশস্ত্র বিপ্লবীদের দ্বারা প্রথমে আহত হয়ে  একজনের মারা যাওয়া এবং পরে হাসপাতালে অপরজনের মারা যাওয়ার পর ও  হেডগেওয়ারের  কেন কোন রকম প্রতিক্রিয়া নেই ?
              

এই পর্যায়ক্রম টি , ভারতের জাতীয় আন্দোলনের ইতিহাসে  এই গুরুত্বপূর্ণ অংশটি কিন্তু যখন অনুষ্ঠিত হচ্ছে, তখন হেডগেওয়ার নাগপুরে ব্রিটিশের বিরুদ্ধে নানা ধরনের বীরত্ব মূলক কাজের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছেন বলে আরএসএস যে দাবি করছে ,সেই দাবির পেছনে যদি বিন্দুমাত্র ইতিহাস গত সত্যতা থাকতো ,তাহলে বিপ্লবীদের এই কাজকর্মের পর কেন হেডগেওয়ারের  কোনো রকম প্রতিক্রিয়া আমরা পাচ্ছি না?
            

ওই দুজন সাহেব  খুন হওয়ার প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ব্রিটিশ বালগঙ্গাধর তিলকের  কেশরি এবং পুনে বৈভব কে নিষিদ্ধ করে ।গ্রেপ্তার করা হয় বোম্বাই লেজিসলেটিভ অ্যাসেম্বলি সদস্য বালগঙ্গাধর তিলক , সর্দার বালাসাহেব নাটু  এবং তারাসাহেব নাটুকে ।তারিখটি ছিল ১৮৯৭  সালের ২৭  ও ২৮ শে জুলাই।
               

এই সময়কালে এত বড় একটি ঘটনা ঘটে যাচ্ছে ,যে সময় কাল টিকে আরএসএস ব্যাখ্যা করে থাকে, তাদের প্রতিষ্ঠাতা হেডগেওয়ার ছাত্রজীবনে স্কুলের ভেতরে ব্রিটিশের রানী এলিজাবেথের সিংহাসন আরোহণের বার্ষিকী পালন কে ঘিরে নিজের দৃঢ় আপত্তির কথা জানাচ্ছে ,সহপাঠীদের ব্রিটিশের বিরুদ্ধে উদ্বুদ্ধ করছে অথচ একটি বারের জন্য সংবাদপত্রের কণ্ঠরোধ থেকে শুরু করে ,বালগঙ্গাধর তিলকের  মত ব্যক্তিত্ব ,যাঁর চিন্তা চেতনার সঙ্গে স্বদেশিয়ানার পাশাপাশি ,হিন্দু পুনরুত্থাণবাদী চিন্তা-চেতনা অনেক বেশি শক্তিমান ছিল ,তিনি এবং তাঁর সহযোগীদের কার্যত বিনা বিচারে আটক করে রাখা নিয়ে কেন হেডগেওয়ারের  পক্ষ থেকে একটি শব্দ ও আমরা শুনতে পাচ্ছি না?
              

ব্রিটিশের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে তিলক সহ তাঁর সহকর্মীরা গ্রেপ্তার হওয়ার পর মারাঠা পত্রিকা লিখছে;
             বোম্বাই সরকারকে যথার্থ অভিনন্দন জানাতে হবে ।তারা পুনা শহরে সাফল্যের সঙ্গে সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করতে পেরেছেন । এই জিনিসটি পুনরায় নাগরিকদের উপহার দেওয়ার প্রতিশ্রুতি ব্রিটিশ সরকার দিয়েছিলেন তাদের এক মারকামারা প্রতিনিধি মিস্টার ল্যামের মাধ্যমে।
                এই প্রতিশ্রুতি জ্ঞাপন করেছিলেন মিস্টার ল্যাম ।প্রতিশ্রুতির মূল্য আমরা হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করছি, এবং অপেক্ষা করে বসে আছি  যে ল্যাম  এবং তার পিতৃপুরুষদের করুণা  কত দূর বিস্তৃত হতে পারে সেইটা দেখবার জন্য। আমাদের জানানো হয়েছে; আমরা যতদূর ভাবতে পারি ,সরকারের ব্যবস্থা গ্রহণের ক্ষমতা তার থেকেও অনেক অনেক বেশি পরিমাণে রয়েছে ।
                আমরা কিন্তু খুব ভালোভাবে বুঝতে পারছি যে ;আমাদের কাছে তা কল্পনাতীত ভাবে অধিক বৈচিত্র্যপূর্ণ। কারণ ;আমরা কেউ কি স্বপ্নে ভাবতে পেরেছিলাম ,সরকার বস্তাপঁচা আইন বের করে আনবেন। সেই আইনের তালিকার শেষ প্রান্তটি বন বিড়ালের ধারালো নখ দিয়ে আর তীক্ষ্ণ করে তুলবে।আর সেই আইনের দ্বারা প্রজাদের নাজেহাল করবে?
            আইনের  নাম করে কিন্তু আমরা যতদিন বাঁচি ততদিন শিখি ।সরকারের  তাদের কথা ও কাজে দারুণ মিল। নিজেদের কর্মপদ্ধতির ভেতর দিয়ে এই মিলটা সরকার  দেখিয়েছে। সারাটা সময় তারা প্রলোভন দমন করেছে,  একেবারে ঋষিদের মতো, নিরপেক্ষ তদন্তের দাবি সম্পর্কে ।
                একথা কিন্তু খুব জোরের সঙ্গে বলতে পারা যায় ;বিনা বিচারে পুনার নাগরিকরা দোষী সাব্যস্ত করা  হয়েছে এবং সেই অনুযায়ী তাঁরা শাস্তি পেয়েছেন। সকাল-সন্ধ্যায় এখন দেখা যায় পথে পথে ইউরোপীয় কনস্টেবলরা টহল দিচ্ছে। যারা এতদিন ছিল অতিরিক্ত অবসরের দ্বারা ক্লান্ত ।এই সময় তারা শহরে ব্যস্ত চূড়ান্ত নিস্তব্ধতার দ্বারা মানুষকে চরম হেনস্থা করতে।
                  খুব বিশ্বাসের  সঙ্গে আমাদের ভাবতে হচ্ছে;  এই অতিরিক্ত পুলিশ বাহিনীর কি প্রয়োজন ছিল, যখন পুনা জীবিত নয় ,মৃতের শহরে পর্যবসিত হয়েছে ?”
            পুনা -নাগপুরের ভৌগলিক দূরত্ব কত খানি ?পুনা শহরে যখন এই ধরনের দানবীয় সন্ত্রাস ব্রিটিশ সরকার চালাচ্ছে, তখন বৃটিশের বিরুদ্ধে আন্দোলনের বীজ বপন করছেন হেডগেওয়ার নাগপুরে বসে– এই যে দাবি আরএসএস করে থাকে ,সেই দাবির মধ্যে যদি এতোটুকু নি যথার্থতা থাকতো, তাহলে পুনা  কর্মকাণ্ড সম্পর্কে কেন হেডগেওয়ারের কোন উদ্যোগ ছিল না ?কেন হেডগেওয়ারের  জীবনের শৈশব-কৈশোরের ইতিহাস বর্ণনা করতে গিয়ে তার ৮ এবং  ১২  বছরের কর্মকাণ্ডের পর, তাকে একেবারে নিয়ে গিয়ে ফেলা হলো ২০ বছরের যৌবনের দ্বারপ্রান্তে ?
             

ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে বক্তৃতা এবং রচনায় ঘৃনা সৃষ্টির অভিযোগে যখন লোকমান্য বালগঙ্গাধর তিলক অভিযুক্ত হচ্ছেন ,তখন কেন শিশু-কিশোর হেডগেওয়ার,  যাকে কিনা  ব্রিটিশের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের একটি স্ফুলিঙ্গ বলে আরএসএস দেখাতে চায়, সেই হেডগেওয়ার সম্পূর্ণ নীরবতা পালন করে গেল?
              

অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান খবরের কাগজ গুলি  সহ গোটা ইংল্যান্ডের খবরের কাগজ গুলি তিলকের বিরুদ্ধে যখন নানা ধরনের কুৎসায়  তৎপর,  তখনও কেন হেডগেওয়ার পালন করে গেলে আশ্চর্য রকমের নীরবতা? তিলকের বিচারপর্ব আরম্ভ হলো প্রকাশ্যে। সেই প্রকাশ্য বিচারের  নামে প্রহসনের পর  বিচারপতি তিলকদের ১৮ মাস সশ্রম কারাদণ্ড দিয়েছিল। সেই বিচারে, সে যুগের রীতি অনুযায়ী মোট ৯  জন জুড়ি ছিল ।তার মধ্যে ছিল ৬ জন ইউরোপীয় আর ৩ জন ভারতীয় ।
                সব কয়েকজন ইউরোপীয় জুড়ি ই তিলককে  দোষী সাব্যস্ত করেছিল। আর সব কয়জন ভারতীয় জুড়ি তিলককে  নির্দোষ বলে ঘোষণা করেছিলেন ।এই কার্যক্রমের সময় কেন হেডগেওয়ার বা তার যে সহপাঠিদের সে  ব্রিটিশের বিরুদ্ধে উদ্বুদ্ধ করেছিল  বলে আরএসএস ,তাদের কর্মী -সমর্থকদের কাছে প্রচার করে থাকে, সেই সব ব্যক্তিরা একদম শ্মশানের নীরবতা পালন করেছিল ?

Spread the word