‘‘নিজের বুকের রক্তে নক্ষত্রের উজ্জ্বল অক্ষরে/ লিখে রেখো নাম/কালের রাখাল তুমি/ তুমি ভিয়েতনাম।’’—লিখেছিলেন এই বাংলারই কবি কৃষ্ণ ধর। ভিয়েতনাম সংহতি আন্দোলনের উত্তাল দিনগুলিতে। ভিয়েতনাম সত্যিই পশ্চিমবঙ্গে শুধু একটি নাম নয়। মাথা উঁচু করে বাঁচার সাহসী শপথ। বাংলার আবেগ যেন অন্তহীন ভিয়েতনাম নিয়ে। হো চি মিনের ১৩১তম জন্ম দিবসেও যেন সেই অনুভূতিরই অনুরণন।
১৯৯০ সালে হো চি মিনের জন্মশতবর্ষ বিশ্বজুড়ে উদযাপন করেছিল রাষ্ট্রসংঘের ইউনেস্কো। সময় মোটেই অনুকূলে ছিল না। সোভিয়েত ইউনিয়নের সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা বিপর্যয়ের দোরগোড়ায়। ‘ইতিহাস অবসান’-এর আনন্দে উদ্বাহু নৃত্য করছে পশ্চিমী প্রচারককুল। কিন্তু সেই তথাকথিত ‘সমাজতান্ত্রিক-উত্তর’ সময়ের মুখে দাঁড়িয়েও মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সফল লড়াইয়ের মূর্ত প্রতীক হো চি মিনকে নিয়ে এমনকি ইউনেস্কোর উচ্ছাসেও লাগাম পরাতে পারেনি ‘নয়া বিশ্ব ব্যবস্থা’র ধ্বজাধারীরা। ইউনেস্কোর সরকারী প্রস্তাবে হো চি মিন সম্পর্কে বলা হয়: ‘‘ভিয়েতনামিজ হিরো অফ ন্যাশনাল লিবারেশন অ্যন্ড গ্রেট ম্যান অফ কালচার’’।
ঔপনিবেশিক শাসনমুক্ত ভিয়েতনাম গঠনে এবং সমাজতান্ত্রিক ভিয়েতনাম নির্মাণে হো চি মিনের অবদান অবিস্মরণীয়। ভিয়েতনামই দক্ষিণপূর্ব এশিয়ায় প্রথম ঔপনিবেশিক পরাধীনতামুক্ত দেশ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অবসানে ১৯৪৫ সালের ২ সেপ্টেম্বর ভিয়েতনাম মুক্ত হয় ফরাসী ঔপনিবেশিক শাসন থেকে। কিন্তু ফরাসী ঔপনিবেশিক জমানা দেশের দক্ষিণাংশের দখলদারি ছাড়েনি। কারন তাদের পিছনে ছিল, প্রথমে গোপনে, তারপর প্রকাশ্যে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ। ১৯৬৯ সালেরই ৩ সেপ্টেম্বর হো চি মিনের জীবনাবসান। হো চি মিনের মৃত্যুর ছ’বছর পর, ১৯৭৫-র ৩০ এপ্রিল সায়গনের ( এখন নাম হো চি মিন শহর) মুক্তি। মার্কিন বাহিনীকে পর্যুদস্ত করে ভিয়েতনামের জনগণের চূড়ান্ত বিজয়। মুক্ত হয় দক্ষিণ ভিয়েতনাম। ১৯৭৬ সালের ২ জুলাই উত্তর ও দক্ষিণের পুনর্মিলনের সূত্রে আত্মপ্রকাশ করে ভিয়েতনাম সমাজতান্ত্রিক সাধারণতন্ত্র। বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিধর সাম্রাজ্যবাদী দেশ মাথা নত করে হো চি মিনের উত্তরসূরীদের কাছে।
ভিয়েতনামের মাটিতে বীর সেনানীদের জয় যেমন অতুলনীয়, তেমনই মহাকাব্যিক বিশ্বজুড়ে ভিয়েতনাম সংহতি সংগ্রাম। খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরে ভিয়েতনাম যুদ্ধবিরোধী আন্দোলন বিশ্বব্যাপী সাম্রাজ্যবাদ আধিপত্যবাদবিরোধী আন্দোলনকে অনুপ্রাণিত করেছে। অনুপ্রাণিত করেছে ভারতকেও। ভিয়েতনামের প্রতি সংহতিতে সবচেয়ে আন্দোলিত সম্ভবত গণআন্দোলনের পীঠস্থান কলকাতা তথা বাংলা।
ভিয়েতনাম সংহতি আন্দোলনের একাধিক পর্ব। উল্লেখ্য, ১৯২৭ সালে ব্রাসেলসে লিগ এগেন্স্ট ফ্যাসিজম অ্যান্ড ওয়ারের বিশ্বসম্মেলনে জাতীয় কংগ্রেসের হয়ে যোগ দিয়েছিলেন মতিলাল নেহরু ও জওহরলাল নেহরু। সেই সম্মেলনে ইন্দোচীনের তরফে ছিলেন হো চি মিন। তখনও তিনি ফরাসী কমিউনিস্ট পার্টির নেতা। তৃতীয় আন্তর্জাতিকের সঙ্গে যুক্ত। ইন্দোচীনের কমিউনিস্ট পার্টি গঠিত হয় কয়েক বছর পর। হো চি মিনের তখনকার বহু লেখায় এসেছে ঔপনিবেশিক ভারতের প্রসঙ্গ। প্রসঙ্গত, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ভিয়েতনামের সায়গন শহরে সফরে গিয়েছিলেন ১৯২৯ সালের ২১-২২জুন। তখনকার ভিয়েতনামের ফরাসী কর্মকর্তারা ছাড়াও সংস্কার আন্দোলনের নেতৃস্থানীয়রাও রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা করেন।
উপনিবেশ ভারতে ‘ইন্দোচীন দিবস’ পালিত হয় ১৯৪৫ সালের ২৫ অক্টোবর। দক্ষিণপূর্ব এশিয়ায় ফরাসী ও ওলন্দাজ ঔপনিবেশিক প্রশাসনের স্বার্থে ভারতের ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক সরকার ইঙ্গ-ভারতীয় সেনা পাঠানোর সিদ্ধান্ত নিলে প্রতিবাদ জানায় জাতীয় কংগ্রেস ও কমিউনিস্ট পার্টি। পালিত হয় ‘ইন্দোচীন দিবস’। ততদিনে ১৯৪৫ সালের ২ সেপ্টেম্বর চাচা হো-র নেতৃত্বে হ্যানয়ে আত্মপ্রকাশ করেছে ভিয়েতনাম গণতান্ত্রিক সাধারণতন্ত্র। উল্লেখ্য ঐ ২ সেপ্টেম্বরেই জাপান আত্মসমর্পন করে। আনুষ্ঠানিকভাবে শেষ হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। ফ্যাসিবাদের পরাজয়ের প্রেক্ষাপটে ভারতে ‘ইন্দোচীন দিবস’-র তাৎপর্য ছিল অপরিসীম।
এর কয়েক মাস পরেই হো চি মিন দু’দিনের জন্য কলকাতায় এসেছিলেন। প্যারিসে যাওয়ার পথে যাত্রাবিরতি। তখন তিনি ভিয়েতনামের প্রধানমন্ত্রী। ১৯৪৬ সালের জুন মাসে। ছিলেন গ্রেটইস্টার্ন হোটেলে। পাশেই ডেকার্স লেনে কমিউনিস্ট পার্টির পত্রিকা ‘স্বাধীনতা’র অফিসে গিয়েছিলেন।
তারপরও হো চিন মিন কলকাতায় এসেছেন। ১৯৫৮ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি। রাষ্ট্রিয় সফর। দিল্লি বোম্বাই ঘুরে কলকাতায়। সেই সফরের প্রায় এগারো বছর আগে ভিয়েতনাম সংহতি আন্দোলনের নতুন ইতিহাস তৈরি হয় কলকাতায়।
ভিয়েতনামে ফরাসী আগ্রাসনের প্রতিবাদে ভারতে ১৯৪৭ সালের ২১ জানুয়ারি (মঙ্গলবার) পালিত হয় ‘ভিয়েতনাম দিবস’। ব্রিটিশ শাসন তখন শেষ পর্যায়ে।‘ভিয়েতনাম দিবস’ পালনের মূল উদ্যোক্তা ছিল নিখিল ভারত ছাত্র ফেডারেশন। সংহতি জানায় অল ইন্ডিয়া ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেস। কলকাতা তথা পশ্চিমবঙ্গ ছিল সেই সংহতি আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু। কলকাতায় ধর্মঘট ভাঙতে ঔদিন পুলিস গুলি চালালে প্রাণ হারান স্কটিশচার্চ কলেজের ছাত্র সুখেন্দুবিকাশ নাথ এবং কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের ছাত্র ধীররঞ্জন সেন। কলেজ স্ট্রিটে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেনেট হলের সামনে পড়েছিল সুখেন্দুবিকাশের গুলিবিদ্ধ মৃতদেহ। পুলিশের গুলিতে আহতদের মধ্যে ছিলেন ছাত্র ফেডারেশন কর্মী রণমিত্র সেন। পরে তিনি দৈনিক স্বাধীনতা-র সাব এডিটর হন। ১৯৫৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে কলকাতা সফরকালে হো চি মিনকে রাজভবনে ডেকে পাঠিয়ে দেখা করেছিলেন রণমিত্র সেনের সঙ্গে। কলকাতায় হো চি মিন-কে সেবার নাগরিক সম্বর্ধনাও দেওয়া হয়।
১৯৬০-র দশকে বিশ্বব্যাপী ভিয়েতনাম সংহতি আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে ছিল সেদেশে মার্কিনী সেনাবাহিনীর নৃশংস সামরিক সন্ত্রাস। ফরাসী ঔপনিবেশিক জমানাকে পর্যুদস্ত করেও ভিয়েতনামবাসীর লড়াই থামেনি। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের নয়া-ঔপনিবেশিক দখলদারি থেকে স্বদেশমুক্তির সংগ্রামের নতুন পর্ব শুরু করতে হয় ভিয়েতনামবাসীকে। হো চি মিনের নেতৃত্বে। ১৯৬০ সালের সেপ্টেম্বরে ভিয়েতনাম ওয়ার্কার্স পার্টির তৃতীয় কংগ্রেসে বিপ্লবের দু’দফা কর্তব্য চিহ্নিত হয়— উত্তরাংশে সমাজতান্ত্রিক নির্মাণ এবং দক্ষিণাংশকে মুক্ত করা ও দেশের শান্তিপূর্ণ পুনর্মিলন। মার্কিন সামরিক বাহিনী নৃশংসতার নতুন নজির সৃষ্টি করেছিল ভিয়েতনামের মাটিতে। আন্তর্জাতিকভাবে নিষিদ্ধ রাসয়ানিক অস্ত্র প্রয়োগ করতেও তারা দ্বিধা করেনি। যার কুফল ভোগ করতে হচ্ছে ভিয়েতনামে আজকের প্রজন্মকেও।
হো চি মিনের নেতৃত্বে ভিয়েতনামবাসীর অসামান্য প্রতিরোধ যুদ্ধের পাশে এসে দাঁড়ায় বিশ্বের সব প্রান্তের মানুষ। শেষ পর্যন্ত পরাস্ত হয় মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ। হো চি মিন নিজে এই ঐতিহাসিক জয় ও পুনর্মিলিত ভিয়েতনাম দেখে যেতে পারেন নি। কিন্তু তাঁর আদর্শের পথ ধরেই ভিয়েতনাম অজেয়। তাই এখনও হো চি মিন সাম্রাজ্যবাদ- আধিপত্যবাদ- বিরোধী সংগ্রামের অনুপ্রেরণা।
‘তোমার নাম আমার নাম ভিয়েতনাম ভিয়েতনাম ’ – ১৯৬০ আর ১৯৭০-র দশকে কলকাতা কল্লোলিত হয়েছে এই শ্লোগানে। ভিয়েতনামের মানুষ আজও কলকাতার সংহতি আন্দোলনকে বিশেষভাবে মনে রেখেছেন। ১৯৬০-র দশকে মোটামুটিভাবে ১৯৬৪ থেকে ১৯৭৫-র ৩০ এপ্রিল সায়গন মুক্ত হওয়া পর্যন্ত কলকাতায় একটানা নিয়মিত কর্মসূচী পালিত হয়েছে ভিয়েতনামের প্রতি সংহতি জানিয়ে। সংহতি আন্দোলনের দিক থেকে এঘটনা নজিরবিহীন।
১৯৬৪ সালের ৭ আগস্ট মনুমেন্ট ময়দানে ভিয়েতনামের সংগ্রামী জনতার প্রতি সংহতি জানিয়ে সাত বামপন্থী দলের ( বাম-সিপি আই, এস ইউ সি, বলশেভিক পার্টি, আর এস পি, আর সি পি আই, ওয়ার্কার্স পার্টি, মার্কসবাদী ফরওয়ার্ড ব্লক) যৌথ সভা হয়। প্রধান বক্তা ছিলেন জ্যোতি বসু। সভা শেষে মার্কিন দূতাবাস অভিমুখে মিছিল করা হয়।
১৯৬৭-র ২০ জুলাই কলকাতায় পালিত হয় আন্তর্জাতিক ভিয়েতনাম সংহতি দিবস। মনুমেন্ট ময়দানে আয়োজিত সভার আহ্বায়ক ছিল-—বি পি টি ইউ সি, ইউ টি ইউ সি, ইউ টি ইউ সি (ধর্মতলা স্ট্রিট), ব্যাঙ্ক কর্মচারী সমিতি, জীবনবীমা কর্মচারী সমিতি, মার্কেন্টাইল কর্মচারী ফেডারেশন, পেট্রল কর্মচারী ইউনিয়ন,স্টেট ট্রান্সপোর্ট কর্মচারী ইউনিয়ন, সিনেমা কর্মচারী ফেডারেশন, জেনারেল ইন্সিওরেন্স কর্মচারী অ্যাসোসিয়েশন, বঙ্গীয় প্রাদেশিক শিক্ষক সমিতি, প্রাথমিক শিক্ষক সমিতি এবং পশ্চিমবঙ্গ প্রাদেশিক কৃষক সভা।
১৯৬৮-র ২০ জুলাই ভিয়েতনামের সংগ্রামের সমর্থনে সুবোধ মল্লিক স্কোয়ারে জনসভা হয়। উদ্যোক্তা ‘ভিয়েতনাম মুক্তি সংগ্রাম সংহতি কমিটি’। সভাপতিত্ব করেন বিমান বসু। বক্তা ছিলেন সুভাষ চক্রবর্তী, শ্যামল চক্রবর্তী্ প্রমুখ।
১৯৬৮ সালের ২০-২২ নভেম্বর বিশ্বব্যাঙ্ক সভাপতি এবং প্রাক্তূন মার্কিন প্রতিরক্ষা সচিব রবার্ট ম্যাকনামারার সফর উপলক্ষে বিক্ষোভে উত্তাল কলকাতা। বিক্ষোভ এড়াতে ম্যাকনামারাকে দমদম বিমান বন্দর থেকে হেলিকপ্টারে রেসকোর্স মাঠে নিয়ে আসা হয়। ২০ নভেম্বর সারা বাংলা ছাত্র ধর্মঘট পালিত হয়। পুলিশ ১৪৪ ধারা জারি করে। ব্যাপক ধরপাকড় চালায়।
১৯৬৯ সালের ৩ সেপ্টেম্বর হো চি মিনের জীবনাবসান হয়। পশ্চিমবঙ্গে তখন দ্বিতীয় যুক্তফ্রন্ট সরকার। হো চি মিনের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে ৬ সেপ্টেম্বর রাজ্যে সরকারী অফিসসমূহে ছুটি দেওয়া হয়। হো চি মিনের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে যুক্তফ্রন্টের ডাকে সারা রাজ্যে মৌন মিছিল হয় ১০ সেপ্টেম্বর । ১২ সেপ্টেম্বর কলকাতা পুরসভা হারিংটন স্টিটের নাম বদলে করে হো চি মিন সরণি। প্রশান্ত শূর তখন কলকাতার মেয়র। প্রসঙ্গত, ১৯৯০ সালে হো চি মিন জন্ম শতবর্ষে ভারতীয় সরকারী প্রতিনিধি দলের নেতা হিসেবে ভিয়েতনাম গিয়েছিলেন জ্যোতি বসু। সে সময় তিনি মুখ্যমন্ত্রী। ভারতীয় প্রতিনিধি দলের অন্যতম সদস্য ছিলেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। পরবর্তীকালে জেনারেল গিয়াপের মতো ভিয়েতনামের কিংবদন্তী নেতাও কলকাতায় এসেছেন।
১৯৭০-র ১৮ জুলাই প্যারিস যাওয়ার পথে দমদম বিমানবন্দরে যাত্রা বিরতি ঘটান দক্ষিণ ভিয়েতনামের অস্থায়ী সরকারের বিদেশ মন্ত্রী মাদাম বিন। বিমান বন্দরেই তাঁকে সংবর্ধনা জানান পি সুন্দরাইয়া, জ্যোতি বসু, এম বাসবপুন্নাইয়া, প্রমুখ। প্যারিস থেকে ফেরার পথে ৩০ জুলাই কলকাতায় রাজ্যপালের অতিথি হিসেবে মাদাম বিন রাতে রাজভবনে কাটান। ২০০৭ সালের সেপ্টেম্বরে মাদাম বিন আবার কলকাতায় এসেছিলেন ভারত-ভিয়েতনাম উৎসবে অংশ নিতে।
১৯৭১ সালে ২০ জুলাই বামপন্থী ছাত্র-যুব সংগঠনগুলির ডাকে ‘ভিয়েতনাম সংহতি দিবস’ পালিত হয়। ১৯৭২ সালের ৬মে ভিয়েতনামের সমর্থনে পাঁচটি বামপন্থী কেন্দ্রীয় যুব সংগঠন (গণতান্ত্রিক যুব ফেডারেশন , আর ওয়াই ও, ডি ওয়াই ও, ফেডারেশন অফ পোগ্রেসিভ ইয়ুথ , ইয়ুথ লিগ ) এবং ছয়টি বামপন্থী কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগঠনের ( এস এফ আই , পি এস ইউ, ডি এস ও , স্টুডেন্টস ব্লক, এফ আর এস, আর এস ও) ডাকে সভা ও মিছিল সংগঠিত হয়। সুবোধ মল্লিক স্কোয়ারে অনুষ্ঠিত সভায় বক্তা ছিলেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য, সুভাষ চক্রবর্তি, প্রনব মুখার্জি, বিপ্লব সিদ্ধান্ত প্রমুখ। সভার পর মিছিল যায় চৌরঙ্গীতে মার্কিন প্রচার দপ্তরের সামনে। নিক্সনের কুশপুত্তলিকা দাহ করা হয়।
১৯৭২ সালেরই ২২-২৭ মে ভিয়েতনামের প্রতি সংহতি জানিয়ে কলকাতায় মার্কিন প্রচার দপ্তরের সামনে ছাত্র যুব মহিলা সংগঠনগুলি অবস্থান বিক্ষোভ সংগঠিত করে। ২২ মে পালিত হয় ছাত্র-যুব দিবস। ঐদিন প্রচার দপ্তরের সামনে সমাবেশে ভাষণ দেন বামপন্থী ফ্রন্টের নেতৃবৃন্দ , প্রমোদ দাশগুপ্ত, সুবোধ ব্যানার্জি , জ্যোতি ভট্টাচার্য , সুনীল সেনগুপ্ত , সুধীন কুমার।২৩ মে পুলিস সমাবেশে নৃশংসভাবে লাঠি চালায় । গ্রেপ্তার করে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যসহ ছাত্র যুব সংগটনগুলির বেশ কয়েকজন নেতাকে। ২৬ মে তারিখেও পুলিস সমাবেশে লাঠি চালায়। ২৪ মে পালিত হয় শ্রমিক-কর্মচারী দিবস। ২৫ মে পালিত হয় সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী দিবস। ২৫ মে পালিত হয় সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী দিবস। ২৬ মে পালিত হয় মহিলা দিবস। ২৭ মে শহীদ মিনারে আয়োজিত সমাবেশে অন্যতম বক্তা ভারতে নিযুক্ত উত্তর ভিয়েতনামের প্রতিনিধি লে মিন ভাষণ দেন ।
১৯৭৫ সালের ৩০ এপ্রিল দক্ষিণ ভিয়েতনাম মুক্ত হয়। ৭ মে ভিয়েতনামের প্রতি সংহতি জানিয়ে শহীদ মিনারে সমাবেশ সংগঠিত হয় বিজয় উৎসব। সভাপতি ছিলেন কৃষ্ণপদ ঘোষ। বক্তা জ্যোতি বসু, প্রমোদ দাশগুপ্ত। ১৩ জুন ভিয়েতনাম সংহতি কমিটির উদ্যোগে শহীদ মিনার ময়দানে সংবর্ধনা দেওয়া হয় দক্ষিণ ভিয়েতনামের অস্থায়ী বিপ্লবী সরকারের ভারতস্থ চার্জ দ্য অ্যফেয়ার্স ভো-হাই-হিয়েন-কে। সভাপতিত্ব করেন ভিয়েতনাম সংহতি কমিটির সভাপতি জ্যোতি বসু। এর বারো দিন পরই দেশে জরুরী অবস্থা জারি হয়।
লড়াকু ভিয়েতনামের পাশে দাঁড়ায় কলকাতার গণসাংস্কৃতিক আন্দোলন তাঁদের সৃষ্টসম্ভার নিয়ে। সম্ভবত ১৯৬৫ সালে সাধন গুহ লিখেছিলেন গান ‘‘সারা পৃথিবীর বজ্র মুঠির অগ্নিশপথে লাল সেলাম…’’। সুরকার দিলীপ মুখোপাধ্যায়। সম্ভবত ১৯৬৫ সালে। সাধন গুহই হো চি মিনের মৃত্যুর (১৯৬৯) পর গান লিখেছিলেন-‘‘নো নো ফর নেভার…’’। খুবই জনপ্রিয় ছিল হো চি মিনের ‘দ্য কল’ কবিতাটির বঙ্গানুবাদ করে লেখা গান –‘‘সময় এসেছে আজ দ্বিধাহীন যুদ্ধের…’’। গীতিকার শশাঙ্ক গঙ্গোপাধ্যায়। সুরকার মণিলাল মজুমদার।
ভিয়েতনামকে কেন্দ্র করে নাটক লেখা হয়েছিল কয়েকটি। প্রথম নাটক চিররঞ্জন দাসের একাঙ্ক ‘ভিয়েতনাম’। সীমান্তিক শাখা প্রযোজনা করত। ১৯৬৫ সালের ১৪ জুলাই সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি রোডে মার্কিন তথ্য কেন্দ্রের সামনে ছাত্রদের অবরোধ কর্মসূচী চলাকালীন সীমান্তিক শাখা নাটকটি প্রথম অভিনয় করে। পরে হিন্দি, ভোজপুরী, অসমীয়া ও ওড়িভাষায় অনূদিত হয়ে সারা ভারতে বহু দল নাটকটি অভিনয় করে।
উৎপল দত্তের ‘অজেয় ভিয়েতনাম’ লিটল থিয়েটার গ্রুপ প্রথম অভিনয় করে ১৯৬৬ সালের ৩১ আগস্ট মিনার্ভায়। তবে তার আগে ১৯ আগস্ট ভিয়েতনামের প্রতি সংহতি জানিয়ে মনুমেন্ট ময়দানে ‘সংগ্রামী ভিয়েতনাম সুহৃদ সমিতি’-র উদ্যোগে লেখক শিল্পী বুদ্ধিজীবীদের সমাবেশে লিটল থিয়েটার গ্রুপ ‘অজেয় ভিয়েতনাম’ নাটকের একটি দৃশ্য অভিনয় করে। পরে নাটকটি ইংরাজী এবং জার্মান ভাষায় অনুবাদ করা হয়েছিল।
ভিয়েতনাম নিয়ে সমকাল আর একটি বিখ্যাত নাটক ‘সাম্প্রতিক’ শাখার নেপাল ঘোষ রচিত পূর্ণাঙ্গ নাটক ‘দেশে দেশে’। মিনার্ভায় ১৯৬৬ সালের ১২ সেপ্টেম্বর প্রথম এর মঞ্চায়ন হয়। ‘দেশে দেশে’ লেখা হয় দক্ষিণ ভিয়েতনামের জাতীয় বীর নগুয়েন ভান ত্রই—র জীবন লেখা বই ‘দ্য ওয়ে হি লিভড’ অবলম্বনে। একই কাহিনী অবলম্বনে জোছন দস্তিদার রচিত ও পরিচালিত রূপান্তরী গোষ্টী ১৯৬৬ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর পরিবেশন করে ‘অমর ভিয়েতনাম’ নাটকটি। এছাড়াও ১৯৬৯ সালে শ্রীজীব গোস্বামী (বাসুদেব দাশগুপ্ত) লিখেছিলেন ‘মৃত্যুহীন ভিয়েতনাম’ নাটক। সৌরীন সেনের ‘ভিয়েতনাম’ উপন্যাস অবলম্বনে লেখা এই নাটকটি অভিনয় করতো কৃষ্টিসংসদ। বাসুদেব দাশগুপ্ত ভিয়েতনাম নিয়ে গান লেখেন—‘‘এখানে আকাশ মাটি…’’।
ভিয়েতনাম সংহতি আন্দোলন সাম্রাজ্যবাদবিরোধী আন্দোলন আর গণতন্ত্রের সংগ্রামের সঙ্গে যেন একাত্ম হয়ে যায়। ‘তোমার নাম আমার নাম/ ভিয়েতনাম ভিয়েতনাম’ শ্লোগানে যেন ধরা পড়েছে সময়ের দ্যোতনা।
সমাজতান্ত্রিক ভিয়েতনাম আজও অনন্য। করোনা-আক্রান্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে চিকিৎসা মোকাবিলায় অনায়াসে যখন সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয় ভিয়েতনাম, তখন মানব-সংহতির ধারণায় নতুন মূল্য যুক্ত হয় ভিয়েতনামের হাত ধরে।