Site icon CPI(M)

ভ্রাতৃঘাতী দাঙ্গা বন্ধ হোক – জ্যোতি বসু

[১৯৪৬ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর বঙ্গীয় আইনসভায় ভাষণ]

মাননীয় উপাধ্যক্ষ মহাশয় আমি মনে করি শ্রমিক শ্রেণীর কেন্দ্র থেকে নির্বাচিত প্রতিনিধি হিসেবে ইউ আলোচনায় আমার অবশ্যই অংশগ্রহণ করা উচিত। যে কেন্দ্রে হিন্দু, মুসলমান উভয় ধর্মালম্বীই আছেন। গোটা শহর জুড়ে সাম্প্রদায়িক হানাহানি এই মহানগরীকে হতমান করেছে এবং সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ভাবে আমাদের রাজনৈতিক জীবনকে কালিমালিপ্ত ক্রেসিগে তখন কলকাতা ও শহরতলির শ্রমিকশ্রেণী এই ঘটনা সম্পর্কে তুলনামূলকভাবে দূরে থেকেছেন আসুন, এর জন্য তাঁদের আমরা সম্মান জানাই।

হাজার হাজার মানুষ কিভাবে নৃশংসতা, কাপুরুষতা ও অমানবিকতায় পতিত হয়েছিল তার বিশদ ব্যাখ্যা আমি করছি না। বরং আমি সভার সমস্ত সদস্য ও দেশবাসীকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে এটাই বলব যে, এক মুহূর্তের জন্যও ভুলিবেন না, আমরা যাই বলি, যাই করিনা কেন, তার উদ্দেশ্য হবে উদ্ধারকার্য্যের প্রতি দৃষ্টি রেখেই সমস্ত বক্তব্য এবং কাজ করার জন্য আন্তরিক আবেদন জানাবো। এই মুহূর্তে সমস্ত শুভেচ্ছা সহ দেশবাসীর রাজনৈতিক অন্তর্দৃষ্টি উদ্দীপনা ও শক্তিকে নির্ভর করে এবং সাম্রাজ্যবাদী কৌশল মোকাবিলায় এবং স্বাধীনতার জন্য তাঁদের নিঃসংশয় সংকল্পকে স্মরণে রেখেই যা কিছু করতে হবে। যে লক্ষ্য আইনের জন্যই হিন্দু ও মুসলিম ক্ষুধা তৃষ্ণা ও যন্ত্রণার মোকাবিলা করেছেন। বাংলায় মুক্তি জীবন ও স্বাধীনতা অর্জনের একমাত্র পথ ইউরোপীয়ানদের বাদ দিয়ে একটি প্রগতিশীল কর্মসূচির ভিত্তিতে কোয়ালিশন সরকার গঠন ।এই লক্ষ্য অর্জন ভোটের মাধ্যমে হবে না । সম্ভব আলোচনার মধ্য দিয়েই , মন্ত্রিসভাকে ত্রুটি বিচ্যুতির জন্য অভিযুক্ত করার আগে, আসুন পর্যায়ক্রমে আমরা বিষয়গুলি আলোচনা করি। যদিও এই মন্ত্রিসভা বহুবিধ অপকর্ম করেছে।যাই হোক দেখুন আমাদের বিরুদ্ধে কাপুরুষোচিত ছলের মূল পান্ডা কারা; যাবতীয় ঘৃণার সঙ্গেই আমাদের অনুধাবন করতে হবে যে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদই আমাদের পয়লা নম্বর শত্রু । তারা আমাদের অবদমিত করেছে, পরস্পরের থেকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে, জনগণকে ভুল পথে চালিত করেছে এবং এখন সগর্বে কলকাতায় নিদারুণ শ্মশানের শান্তি বজায় রাখলেও , যে কোনো সময় তা ভেঙে যেতে পারে।
অতীতে যখনই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়েছে তখনই আমরা, সঠিকভাবেই সাম্রাজ্যবাদকে তার প্রধান উস্কানিদাতা হিসেবে ভৎসনা করেছি এবং আমরা দেখেছি সাম্রাজ্যবাদীদের হাতে দেশবাসী কিরকম অসহায় দুর্বল দাবার বোড়েতে পরিণত হয়। এবারেও দাঙ্গা সম্পর্কে আলাদা করে কিছু ভাবনার কোনো কারণ নেই। আমি প্রভাবিত করতে পারি এমন সমস্ত দেশপ্রেমিক শক্তির সঙ্গে আমিও এই দাঙ্গার প্রধান অপরাধীদের অভিযুক্ত করছি । যাঁরা হোয়াইট হল অথবা দিল্লি অথবা কলকাতার গভর্ন হাউসে আত্মতৃপ্তি নিয়ে অবস্থান করছে এবং সুতোর টানে আমাদের প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলগুলিকে তাদের পাতা ফাঁদে পা দিতে বাধ্য করছে। গত ছ’মাসে ক্যাবিনেট মন্ত্রী কি নিখুঁত খেলাই না খেললেন। কখনো কংগ্রেস এবং কখনো লীগের কানে অমৃতবাণী বর্ষণ করেছেন। এমন সব প্রস্তাব তারা পেশ করলেন যেগুলিকে নানা ভাবে ব্যাখ্যা করা যায়। সবশেষে স্বাধীনতাও নয় এমনকি গণতান্ত্রিক অধিকার বা স্বায়ত্তশাসনের অধিকার দেবার পরিবর্তে তারা যা করল , আমাদের দেশবাসীর এক সম্প্রদায়ের মধ্যে অন্য সম্প্রদায়ের বিরোধকে পরিকল্পিত ভাবে জিইয়ে রাখা ও জনমানসকে বিষিয়ে তোলা এসবের চূড়ান্ত পরিণতি হলো কলকাতার মারাত্মক দাঙ্গা। মাননীয় অধ্যক্ষ এই সমস্ত কিছুর সঙ্গেই আমার প্রশ্ন , ভাইসরয়ের সভাপতিত্বে গভর্নরদের সম্মেলনের কি গোপন পরিকল্পনা আলোচিত হয়েছিল যার ফলে সিন্দের কলকাতার গভর্নর ঠিক তার বিপরীত কাজ করলেন? কি কারণেই বা কলকাতায় সরকার দুদিনের জন্য আক্ষরিক অর্থে অপসৃত হয়েছিল এবং যার ফলে পুলিস তার নির্ধারিত কাজের বদলে লুঠ এবং অগ্নিসংযোগের কাজে সহায়তা করেছিল? পুলিস কিভাবে ধর্মঘট ভাঙে আমরা সবাই জেনেছি। রশিদ আলি দিবসে আমাদের বিপ্লবী যুবকদের মিছিল ভেঙে দিতে তারা কিভাবে তৎপর হয়েছিল তাও আমরা দেখেছি। অর্থাৎ কিভাবে তারা গণঅভ্যুত্থান দমন করে! আমাদের অভিজ্ঞতা আছে কেমন করে ১৯৪২ সালে সরকার কে অন্ধকারে রেখে কিভাবে পুলিস তার সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল। কিন্তু এই দাঙ্গার সময় জনগণ ছিল বিচ্ছিন্ন এবং পুলিস বাহিনী বুঝে নেয় যে তাদেরই জামানা আরো জোরদার হবে। সুতরাং এই স্বৈরতান্ত্রিকদের সংবিধানক রীতির আড়ালে আশ্রয়ও নিতে দিলে হবে না। যদি ইংরেজরা পথিমধ্যে আক্রান্ত হতেন বা তাদের সম্পত্তি লুঠ হতো কিম্বা মিলিটারি ট্রাক জ্বালিয়ে দেওয়া হতো তাহলেও কি তারা একই আচরণ করতেন? উত্তর সহজেই অনুমেয় এবং চোখে পড়বার মতো বিষয় । সি আই ডির তান্ডবের নারকীয় প্রক্রিয়া পূর্ব অভিজ্ঞতা ছাড়া অনুমান করাও অসম্ভব । কারণ দাঙ্গার প্রস্তুতি সম্পর্কে সম্ভাবত তারা ওয়াকিবহাল ছিল। সুতরাং, মাননীয় উপাধ্যক্ষ মহাশয়, আমি দৃঢ়ভাবে ঘোষণা করছি যে, গভর্নর এবং পুলিস কমিশনারের ছন্দ-নিরপেক্ষতা ছিল পূর্ব পরিকল্পিত।

মি. সুরাবর্দি এবং তার মন্ত্রীরা বলার চেষ্টা করছেন যে, তাদের দায়িত্ব কেবল আদেশ করা , আর তা পালন করা পুলিস কমিশনারের কাজ। কিন্তু মি. সুরাবর্দি জানেন তাঁর গাড়ির উইন্ডস্কিন দিয়ে স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করেছেন ১৬ আগষ্ট দুপুরবেলা যে জনসমাগম কেমন করে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেল। তাঁরই অধীনস্থ পুলিস কমিশনার দায়িত্ব পালন করছে কিনা তা দেখা মি. সুরাবর্দির দায়িত্ব । কিন্তু প্রধানমন্ত্রী আন্তরিক ও দৃঢ়তার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করছেন তার ডেপুটি কমিশনারদের সাময়িকভাবে বরখাস্ত করার কথা ভাবছেন? তাঁর সে সাহস নেই কারণ তিনি নিজের ব্যর্থতা তদোপরি সরকারের শোচনীয় ব্যর্থতার কথা জানেন। কিন্তু মুসলিম লীগ সরকার মুসলিম লীগ দল থেকে পৃথক নয় এবং শেষোক্তিটিকে অবশ্যই ত্রুটি-বিচ্যুতির দায়িত্ব নিতে হবে। এসব সত্ত্বেও আমি মনে করি সাম্রাজ্যবাদী নীতি কখনোই আমাদের এমন দুর্দশা করতে পারতো না যদিনা লীগ এবং কংগ্রেস সেই অশুভ চক্রান্তের শিকারে পরিণত না হতো।

আমি প্রথমে লীগের দায়িত্ব সংক্ষেপে উল্লেখ করার চেষ্টা করছি:

১) ১৬ আগস্টের গুরুত্ব ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ১৫ আগস্ট ‘আজাদ’ সম্পাদকীয় লিখেছিল যে ওই দিন পাকিস্তানের জন্য যুদ্ধ শুরু হবে।

২) সারা ভারত লীগ কাউন্সিল ব্রিটিশ এবং কংগ্রেস উভয়কেই শত্রু হিসাবে চিহ্ণিত করেছিল।

৩) মৌলানা আক্রম খান এবনফ ওসমান সাহেব মুসলমানদের পবিত্র রমজান মাসে কাফেরদের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণার দায়িত্ব স্মরণ করে দিয়েছিলন।

৪) পরহিতব্রতী নাজিবুদ্দিন সাহেব বারম্বার ঘোষণা করেছেন, মুসলিমরা অহিংসতার প্রতি অঙ্গীকার বদ্ধ নয়।

৫। সাহসী সুরাবর্দী ঘোষণা করেছিলেন , ব্রিটিশ সরকার কংগ্রেসের সঙ্গে একতরফা বোঝাপড়া করলে তিনি কেন্দ্রের নিয়ন্ত্রণ অবজ্ঞা করবেন এবং বাংলা কে স্বাধীন ঘোষণা করবেন।

৬। সারা ভারত লীগ কাউন্সিলের প্রত্যক্ষ সংঘর্ষ ছিল ১৬মে ক্যাবিনেট মিশনের বিজ্ঞপ্তি মেনে নিতে কংগ্রেসকে বাধ্য করার জন্য। এই বিজ্ঞপ্তিতে কাউকে স্বাধীনতা দেওয়া হয়নি এবং মানুষের ভোট ছাড়াই সাম্প্রদয় ভিত্তিক আসন বিভাজন নীতিকে মেনে নেওয়া। (এই অবস্থায় সদস্য তাঁর নির্ধারিত সময়সীমা পৌঁছান)

মহাশয়, আমি আর কয়েক মিনিট পেতে পারি ?
উপাধ্যক্ষ:…
শ্রী জ্যোতি বসু : মহাশয়, মাননীয় অধ্যক্ষ আমাকে দশ মিনিট সময় বরাদ্দ করেছিলেন। আপনি কি অনুগ্রহ করে আমাকে দুমিনিট সময় দিতে পারেন ?

উপাধ্যক্ষ :…
শ্রী জ্যোতি বসু : আমি আর দুমিনিট সময় চাই। এতে কি আশ্চর্যের কিছু আছে স্যার, যে মুসলিমদের একাংশ তাঁদের নেতাদের গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করেছিলেন এবং প্রত্যক্ষ সংঘর্ষের হাতে কলমে প্রস্তুতি গ্রহণ করেছিলেন এবং এরই পরিণতিতে এই ভ্ৰাতৃঘাতী দাঙ্গা। এর দ্বারা ব্রিটিশ আমাদের উপর নতুন করে শৃঙ্খল চাপিয়ে দিয়েছে। এর ফলে একমাত্র ব্রিটিশ সম্পত্তি সুরক্ষিত হয় এবং হিন্দু ও মুসলিম পরস্পরকে শঙ্কা এবং অবিশ্বাস নিয়ে দেখবে। অন্যদিকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক আন্দোলন সংগঠিত করার বদলে কংগ্রেস ব্রিটিশ পরিকল্পনাকেই গ্রহণ করেছে। এবং এটা জেনে বুঝেই যে ব্রিটিশ সৈন্যবাহিনী ভারত ত্যাগ করছে না, রাজন্যবর্গের নিয়ন্ত্রণকারী আধিপত্য থাকছে এবং চূড়ান্ত ক্ষমতা ব্রিটিশের হাতেই রয়ে যাচ্ছে। এই কারনেই ব্রিটিশ পরিকল্পনায় কংগ্রেস মুসলিম লীগের বিরোধিতার সম্মুখীন হয়েছে এবং কংগ্রেসকে রাজনৈতিক ও মনস্তাত্ত্বিকভাবে এর মোকাবিলার জন্য প্রস্তুত হতে হবে। এই কারণেই মুসলিম লীগের প্রত্যক্ষ সংঘর্ষ কংগ্রেসের কাছে ভীতিকর হয়ে উঠেছিল এবং একটি সফল হরতাল তাদের কাছে ছিল অনাকাঙ্ক্ষিত। সুতরাং ১৫ আগস্ট দেশপ্রিয় পার্কের জনসভায় ১৬ আগস্টের বিরুদ্ধে আবেগ সঞ্চারিত করা হয়েছিল।

এমনকি এখনও সমস্ত অভিজ্ঞতা নিয়ে আমরা বলছি যে, ব্রিটিশ সেনা আমাদের শান্তি দিতে পারে না; কার্ফিউ ঘোষণা, ১৪৪ ধারা জারি এবং নাগরিক স্বাধীনতা অপহরণ কখনোই ভ্রাতৃপ্রতিম আস্থা এবং সহানুভূতির জন্ম দেয় না। ভাইসরয়ের কাছে এই মন্ত্রী সভার অপসারণ চেয়ে আবেদন – নিবেদন ফল হবে না। সরকার ফেলে দেবার চেষ্টাও আমাদের সমস্যার সমাধান করবে না । কারণ মানুষ প্রশ্ন করবেন ‘এরপরে কি’। কেন্দ্রে কোয়ালিশন ছাড়া বাংলায় কোয়ালিশন সম্ভব নয়, লীগের এই যুক্তি অর্থহীন। তাদের অনুধাবন করতে হবে, একদলীয় সরকারের আমলে দেশবাসী কী দুর্দশার সম্মুখীন হয়েছিলেন। একমাত্র দেশপ্রেমের উদ্দীপনা থেকে রাজনৈতিক দলগুলি একযোগে কোয়ালিশন সরকার গঠন করে বাংলাকে বাঁচানোর পরিকল্পনা করতে পারে। আমি উল্লেখ করেছি ইউরোপীয়দের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে এই সরকারের কর্মসূচি হবে প্রগতিশীল আইন। বাঁচার মতো মজুরি , ইউনিয়নের সুরক্ষা , জমিদারি প্রথার উচ্ছেদ, পাটের ন্যায্য নূন্যতম মূল্য , সকলের জন্য পর্যাপ্ত খাদ্য ও বস্ত্র , সম্পূর্ণ নাগরিক অধিকার এবং অবশিষ্ট রাজনৈতিক বন্দীদের মুক্তিদান।

আমরা সেই কারণে অনাস্থা প্রস্তাবের এই বিতর্কে কোনো পক্ষেই ভোট দেবে না কারণ এটা কেবলমাত্র ভ্রাতৃঘাতী লড়াইয়ে ঘৃতাহুতি দেবে। আমরা হিন্দু, মুসলমান সকল সাধারণ মানুষের কাছে তাদের সকল শক্তি সংগঠিত করতে আবেদন করছি। যাতে তারা বারম্বার না পারস্পরিক খুনোখুনিতে জড়িয়ে পড়েন। এতে আমাদের ট্রেড ইউনিয়নগুলি ভেঙে যায়, মজুরি বৃদ্ধির এবং জীবনযাত্রার মানের উন্নতির লড়াই ভেঙে পড়ে, আর ইউরোপীয় অশুভ শাসন শক্তিশালী হয়। রশিদ আলি দিবস,নৌবিদ্রোহ, আই এন এ, বন্দীদের বিচার বিরোধী আন্দোলন এবং ২৯ জুলাইয়ের সাধারণ ধর্মঘটের উদ্দীপনায় উদ্দীপ্ত মানুষ, সংঘবদ্ধ মানুষই নেতাদের সম্মিলিতভাবে কাজ করতে বাধ্য করবেন। মানবতার বিভিন্ন আদর্শ অগ্রসর হবে শান্তি এবং স্বাধীনতার পথে। এই মুহূর্ত, তারা বলুন, ‘কখনোই আমরা আর ভাইয়ের বিরুদ্ধে উদ্যত হব না; কখনোই আমরা আর তাদের বরদাস্ত করব না, যারা হিন্দু ও মুসলিম পার্থক্যের ভিত্তিতে কথা বলে এবং আমাদের পরস্পরের বিরুদ্ধে লড়িয়ে দেয়।”

[ ১৯৪৬ সালে ১৬ আগস্ট ‘প্রত্যক্ষ সংঘর্ষ দিবস’। পালনের ডাক দিয়েছিল অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগ, দাবি ছিল পৃথক পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠন। সেদিন থেকে পরপর অন্তত তিনদিন কলকাতা প্রত্যক্ষ করেছিল জঘন্যতম ভ্রাতৃঘাতী দাঙ্গা। ১৯৪৫ এর নভেম্বরে আই. এন. এ. বন্দীদের দাবিতে উত্তাল কলকাতা, ১৯৪৬ এর ১৬ ফেব্রুয়ারি আই. এন.এ দিবস পালন উপলক্ষে মহানগরী, নৌবিদ্রোহের সেনানীদের প্রতি হিন্দু- মুসলিম মিলিত সংহতির সাক্ষী এই শহর, ১৯৪৬ এর ২৯ জুলাই অবিস্মরণীয় হরতালের সহমর্মী কলকাতা শিউরে উঠেছিল ৪৬-এর মধ্য আগস্টের রক্তস্নানে। অবিভক্ত বাংলায় তখন এইচ. এ. সুরাবর্দীর নেতৃত্বে মুসলিম লীগ সরকার। বাংলা প্রদেশের আইনসভায় প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেস। ১২ সেপ্টেম্বর বাংলা বিধানসভায় অনাস্থা প্রস্তাব এনেছিল কংগ্রেস। বিতর্ক চলেছিল বেশ কয়দিন। ১৯ সেপ্টেম্বর, বৃহস্পতিবার জ্যোতি বসু বক্তব্য রেখেছিলেন। বসুর ভাষণের সময় সভা পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন তৎকালীন উপাধ্যক্ষ তাফাজ্জল আলি। বসুর ভাষণের পর বিকেল ৫.২৫ মিনিটে সভা সেদিনের মত মুলতুবি হয়। ভাষণের শিরোনামটি যুক্ত করা হয়েছে।
উল্লেখ্য, ২২ সেপ্টেম্বর বিধানসভায় কংগ্রেস অনাস্থা প্রস্তাব উত্থাপন করে। ১৩ সেপ্টেম্বর অমৃতবাজার পত্রিকায় জ্যোতি বসু রূপনারায়ন পাল এবং রতনলাল ব্রাহ্মণ, বিধানসভায় তিন কমিউনিস্ট সদস্যের যে যৌথ বিবৃতি প্রকাশিত হয় তার বাংলা অনুবাদ নিচে দেওয়া হলো :
“আমরা, বিধানসভার কমিউনিস্ট সদস্যরা, মন্ত্রিসভার বিরুদ্ধে আনীত অনাস্থা প্রস্তাব সমর্থন করিনি। আমাদের যুক্তিগুলি খুবই সহজ সরল। একদলীয় মন্ত্রিত্ব হচ্ছে গৃহযুদ্ধের স্থায়ী প্ররোচনা কিন্তু এই মন্ত্রিত্ব অপসারিত করাও ঠিক একই ব্যাপার। এই পরিস্থিতিতে বাঁচার একমাত্র উপায় সর্বদলীয় মন্ত্রিসভা এবং একে অপরকে দোষারোপ করে তা সম্ভব নয়। বরং আলোচনার মাধ্যমে একটি অভিন্ন কর্মসূচীতে উপনীত হবার জন্য অভিন্ন সিদ্ধান্তে পৌঁছান যা বাংলাকে বাঁচাবে। কলকাতা সম্প্রতি পারস্পরিক হত্যার নজিরবিহীন তান্ডবের মধ্য দিয়ে গেছে। এবং প্রদেশের সর্বত্র সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা প্রবল। রাস্তাঘাট সৈন্যবাহিনীর হাতে তুলে দিলে ঝগড়া বিবাদ চালিয়ে গেলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে। আমরা জমিউনিস্টরা কখনোই ভাইকে ভাইয়ের বিরুদ্ধে লড়তে সাহায্য করি না বরং অভিন্ন শত্রুর বিরুদ্ধে তাদের একত্রিত করার যথাসাধ্য চেষ্টা করি।

লীগ নেতাদের কেউ কেউ মনে হয়, ভাবছেন যেহেতু কংগ্রেস অন্যান্য প্রদেশে একদলীয় মন্ত্রিসভা গঠন করেছে, বাংলাতেও একদলীয় মন্ত্রিসভা গঠন করার অধিকার তাদের রয়েছে। ঐক্যবদ্ধ মন্ত্রিসভা গঠনের উদ্দ্যেশ্যে কংগ্রেস সভাপতির সঙ্গে লীগ নেতাদের বৈঠক সম্পর্কে লীগ সমর্থক একটি দৈনিক বিরক্তি প্রকাশ করেছে।

আমরা আশা করি, বাংলা-কংগ্রেসের যেমন, ঠিক তেমনই বাংলা-লীগের প্রধান অংশ বাংলা প্রদেশে সম্মিলিত মন্ত্রিসভা গঠনের পক্ষে নিশ্চিতভাবেই তাঁরা গত দুর্ভিক্ষের সময়ে একদলীয় লীগ মন্ত্রিসভা গঠনে অক্ষমতার কথা ভুলতে পারেন না। আজ যদি তাঁরা মন্ত্রিসভার দুটি আসন অথবা মন্ত্রকের বিতরণ নিয়ে দর কষাকষি করেন এবং তা লক্ষ লক্ষ বাঙালী মুসলমানদের দ্বিতীয় দুর্ভিক্ষের কবলে ফেলে দেয়, যদি তাঁরা সাম্রাজ্যবাদী আমলাতন্ত্র এবং কায়েমী স্বার্থের বিপক্ষে রুখে দাঁড়াতে পারে এমন শক্তিশালী মন্ত্রিসভা গঠন করতে অস্বীকার করেন, তাহলে সাধারণ মানুষের বাংলা , হিন্দু ও মুসলমানদের বাংলা , তাঁদের ক্ষমা করবে না।

আমরা বিশ্বাস করি যে বাংলায় কংগ্রেস লীগ কোয়ালিশনের ভিত্তি ডঃ কুমুদ শঙ্কর রায়ের বিবৃতি মতো হতে পারে। কংগ্রেস নেতা, শ্রী কিরণশঙ্কর রায় এবং লীগ নেতা শাহেদ সূরাবর্দি সাম্প্রতিক বিবৃতিতে যে সকল বিষয় উপস্থাপিত হয়েছে, সেগুলি সহজেই দলগুলির মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ন আলোচনার মাধ্যমে মিটে যেতে পারে। পার্টি যে-কোনো রকম গঠনমূলক কার্যে , এবং সাম্রাজ্যবাদী আমলাতন্ত্রের বিরুদ্ধে যে – কোনো ধরনের সংগ্রামে, জমিদারদের বিরুদ্ধে , কায়েমী স্বার্থান্বেষী এবং মুনাফাকারীদের বিরুদ্ধে এবং কোনো ধরনের বাংলা ভাগের বিরুদ্ধে সংগ্রামে ,বিধানসভার ভিতরে এবং বাইরে কমিউনিস্ট পার্টি তাঁদের পূর্ন সমর্থনের আশ্বাস দিচ্ছে”।]

Spread the word