আপনার প্রোফাইলের রিচ কমে গেছে? আগের মত ‘লাইক’ হচ্ছে না? পেজের এনগেজমেন্ট ঝাড় খাচ্ছে? আপনার বন্ধুও কি “স্টিকার কমেন্ট প্লিজ” –করুন আর্তি জানাচ্ছে? রিফ্রেশ করলেও বারবার বস্তাপচা পোস্টই দেখতে পাচ্ছেন? সেক্সিস্ট, মিসোজিনিস্ট, হেট-স্পিচের প্রোফাইল গুলো মার্কেটে দিব্যি কলার তুলে ঘুরে বেড়াচ্ছে? রিপোর্ট করে লাভ হচ্ছে না বলছেন? ঠিকই বলছেন! অবাক হবেন না। আসলে আপনি ফেসবুকের ফাঁদে পড়েছেন! সিট ব্যাক, রিল্যাক্স অ্যান্ড লেট মি এক্সপ্লেন!
প্রতিটা রান্নার যেমন নির্দিষ্ট একটা রেসিপি আছে; যেমন আপনি শুক্তো তে শুঁকনো লঙ্কা, আদাবাটা পাঁচ-ফোড়ন ব্যবহার করেন, ভিনিগার তো ঢালেন না, চিলি চিকেনে ক্যাপ্সিকাম ব্যবহার করেন কাঁচকলা তো দেন না; ঠিক সেরকমই যেকোনো কম্পিউটার গত বিষয়েও একটা রেসিপি আছে –টেকনিক্যাল টার্মে, অ্যালগরিদম। রেসিপি যেমন ধাপে ধাপে আপনাকে বলে দেয় কোন তেল ব্যবহার করবেন, কোন রান্নার শেষ চিনি মেশাবেন, কোনটায় কসুরি মেথি তড়কা মারবেন; ফেসবুকের অ্যালগরিদমও তেমন ঠিক করে দেয় কোন পেজের পোস্ট লোকে বেশি দেখবে, কার পোস্ট না চাইলেও টাইমলাইনে ভেসে উঠবে, কোনটা হালকা চেপে যাবে, কি করলে কমিউনিটি স্ট্যান্ডার্ড ভায়োলেট হবে, কোন ক্ষেত্রে প্রোফাইল রিপোর্ট খাবে।
আচ্ছা এই অ্যালগোরিদম কি নিজে নিজেই রাজনৈতিক পক্ষপাতদুষ্ট হতে পারে? না! কিন্তু অ্যালগোরিদম লেখার কিম্বা ব্যবহার করার মানুষটা তো রাজনৈতিক পক্ষপাতদুষ্ট হতেই পারে, তাই না? আর সেরকমই গুরুতর অভিযোগ ফেসবুকের বিরুদ্ধে। আমেরিকার সংবাদমাধ্যম ওয়ালস্ট্রিট জার্নাল ১৪ই অগাস্টের আর্টিকেলে নির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে লিখেছে যে, ভারতে ফেসবুকের পলিসি মেকাররা ব্যাপকভাবে বিজেপির পক্ষে রাজনৈতিক পক্ষপাত দুষ্ট। কেমন?
অ্যালগরিদম অনুযায়ী ফেসবুকে ঘৃণা ছড়ানোর পোস্ট করা যায় না। এই বিষয়ে নজরদারির জন্য ভারতে ফেসবুকের যে টিম রয়েছে, সেই টিমই তেলেঙ্গানার বিজেপি নেতা টি রাজা সিং-র “মুসলিমরা বিশ্বাসঘাতক এবং রোহিঙ্গা মুসলিমদের গুলি করে মারা উচিৎ” –সংক্রান্ত ফেসবুক পোস্টটি ডিলিট করার এবং তাঁকে ‘বিপজ্জনক ব্যক্তি’ হিসেবে চিহ্নিত করে অ্যাকাউন্টটি স্থায়ী ভাবে ব্যান করার প্রস্তাব পাঠায় টিম-লিড অফিসারের কাছে। তালিকায় ছিল দিল্লির দাঙ্গার আগে কপিল মিশ্রর উস্কানি মূলক ভিডিও, অনন্ত হেগড়ের সাম্প্রদায়িক মন্তব্যও।
কিন্তু সর্ষের মধ্যেই ভূত। টিম লিড, সাউথ এশিয়ান জোনের ফেসবুকের পাবলিক পলিসি এক্সিকিউটিভ অফিসার আঁখি দাস বিজেপির নেতাদের পোস্ট ডিলিট কিম্বা অ্যাকাউন্ট ব্যান তো দুরস্ত, ‘ব্যবসার ও শাসক পক্ষের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষতি হবে’ -অজুহাতে একের পর এক সাম্প্রদায়িক পোস্ট অনুমোদন করতে থাকেন।
কে এই আঁখি দাস? যিনি নিজে মোদীর প্রশংসায় অহরহ পোস্ট করেন। রবিশঙ্কর প্রসাদ, স্মৃতি ইরানির সঙ্গে গদগদ সেলফি তোলেন। ফেসবুকে ভারতীয় মুসলিমদের সম্পর্কে অবমাননাকর মন্তব্যকে সমর্থন করেন। এবং যার দিদি রশ্মি দাস JNU-র ABVP-র প্রেসিডেন্ট ছিলেন। রশ্মি দাস বর্তমানে WOSY-র নামে একটি NGO চালান। যে WOSY-র লিঙ্ক আপনি দেখতে পাবেন ABVP-র ওয়েবসাইটে। যে WOSY-র অফিস আপনি খুঁজে পাবেন দিল্লির RSS ভবনে!
চেস বোর্ডে আঁখি দাস নেহাত বোড়ে। আড়ালের সমীকরণটাই রাজা। বিজেপি সরকার পলিসি মেকিং-এ ফেসবুক কে ব্যবসার বাড়তি সুযোগ দেবে। আর বিনিময়ে ফেসবুকে বিজেপি নেতারা ফেসবুকে ইচ্ছেমত ঘৃণা ছড়াবে। বিজেপি বিরোধী পোস্ট সেন্সর হবে। এটা বুঝতে আপনাকে শার্লক হোমস লাগবে না। রাজস্থান নির্বাচনের আগে অমিত শাহই বলেছিলেন -“যে কোন খবর মুহূর্তের মধ্যে ভাইরাল করার ক্ষমতা আমাদের আছে। সে খবর টক-মিষ্টি-ঝাল কিম্বা মিথ্যা যাই হোক।”
ফেসবুকের সর্ববৃহৎ মার্কেট ভারতে। ইউজার ২৯০ মিলিয়ন। তাই মোদীর জয়ের পরেই জুকেরবার্গ নিজেই আসেন ভারতে। সরকারের সঙ্গে ফেসবুকের বাণিজ্যিক প্রকল্পও চূড়ান্ত হয়। আর হালফিলের ক্রনলজিটাও দেখুন, ফেসবুক জিও-র সঙ্গে ৫.৭ বিলিয়ন ডলারের চুক্তি করল। টিকটক ব্যান হল। ফেসবুকের অধীনস্থ ইন্সট্রাগ্রাম টিকটকের অনুরূপ ‘রিল্স’ অ্যাপ বের করল এবং মুখ থুবড়ে পড়ল। দেরি না করে জিও-ও টিকটক কেনার নেগোশিয়েশন শুরু করল।
রাজনৈতিক পক্ষপাত ছাড়া ব্যবসায়িক কারণেও ফেসবুকের অ্যালগরিদম খুবই চপল। ২০১২-র পরবর্তী সময়ে এই চপলতার মুখ্য লক্ষ্য, পোস্টের অরগ্যানিক রিচ কমিয়ে ইউজারদের পয়সা খরচে বাধ্য করা। ২০১২ তে, ফেসবুকে, আপনার পোস্ট অরগ্যানিক ভাবে, নিজেদের টাইমলাইনে দেখতে পেতেন প্রায় ১৬% ‘ফ্রেন্ডস-ফলয়ার্স’। ২০১৫ তে সেটা ৫.৪%। ২০২০ শুরু থেকে সেটা ১%-র কাছাকাছি। অর্থাৎ আপনার ফ্রেন্ডলিস্টে ৫০০০ বন্ধু থাকলেও, কোন একটি নির্দিষ্ট সময়ে, আপনার পোস্ট দেখতে পাচ্ছেন হাতে গোনা কয়েকজন। সোজা হিসেব, ফেলো কড়ি মাখো তেল।
রইলো বাকি ডেটা সিকিউরিটি! ট্রাম্প কে জয়ী করতে কেমব্রিজ অ্যানালিটিকা কে কিভাবে ফেসবুক সাধারণ মানুষের ব্যক্তিগত ডেটা ব্যবহার করার সুযোগ করে দিয়েছিল কিম্বা সম্প্রতি দিল্লির দাঙ্গা তে সাধারণ মানুষের ব্যক্তিগত ডেটা কিভাবে সাম্প্রদায়িক কারণে ব্যবহার হয়েছিল এসব আপনি ইন্টারনেট ঘাঁটলেই টুকটাক পাবেন। কিন্তু ডেটা সিকিউরিটি, বিগ ডেটা, ডেটা মাইনিং, AI-র হাতে গরম একটা উদাহরণ হল, ফেসবুক লগ-ইন থাকা অবস্থায় অ্যামাজনে একটা মিক্সচার গ্রাইন্ডার, কিম্বা মিন্ত্রা তে একটা সালোয়ার কামিজ সার্চ করে দেখুন; দুদিন পর দেখবেন ফেসবুকে বন্ধুদের পোস্টের মাঝে জুকেরবার্গ আপনাকে মিক্সচার গ্রাইন্ডার কিম্বা সালোয়ার কামিজের বিজ্ঞাপন দেখাতে শুরু করেছে।
যদি মনে হচ্ছে এসব আধুনিক তথ্য-প্রযুক্তির বিষয়ে সরকার কি করবে -তাহলে আপনি কার্টুন নেটওয়ার্ক দেখুন। ডেটা সিকিউরিটির কারণেই চিনের মত ফেসবুক ব্যান করে বিকল্প প্ল্যাটফর্ম বানাতে না পারলেও, পৃথিবীর বহু দেশ নাগরিকদের ব্যক্তিগত ডেটা নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করতে শক্তিশালী আইন প্রণয়ন করে, সেই শর্তের স্বত্বেই ফেসবুককে সে দেশ ব্যবসা করা অনুমোদন দিয়েছে। ফ্রান্স-জার্মানি সহ EU-র বহু দেশ ছাড়াও তালিকায় আছে ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়াও।
নিশ্চয় ফেসবুকের রাজনৈতিক পক্ষপাতদুষ্টতার বিরুদ্ধে লড়তে হবে। নিজেদের পোস্টে এনগেজমেন্ট বাড়িয়ে সংঘবদ্ধ হয়েই লড়তে হবে। ডেটা সিকিউরিটি, নেট নিউট্রালিটির দাবিতে লড়তে হবে। ডেটা মনোপলির বিরুদ্ধে লড়তে হবে। কিন্তু লড়াই মানে পাল্টা ‘হেট স্পিচ’ নয়, পাল্টা ফেক নিউজ নয়, ছবি কিম্বা বক্তব্য বিকৃত করা নয়, কপিরাইট মিউজিক নিজের ভিডিও তে ব্যবহার করে IPR-র বাঁশ খাওয়া নয়। কারণ এগুলো সুস্থ মস্তিষ্কের লক্ষণ নয়। আর সুস্থ মস্তিষ্কের লোকেরা বিজেপিও নয়।
কি বললেন? ফেসবুকের বিরুদ্ধে লড়ার কথা ফেসবুকেই? ব্যাপারটা Oxymoron হয়ে যাচ্ছে না? হ্যাঁ, হচ্ছে তো। আসলে দেশটাই Oxymoron-এ ভরে গেছে। জনকল্যাণকামী সরকার –Oxymoron, বিজেপি আর বিকাশ -Oxymoron, ভারতের গণতন্ত্র –Oxymoron, সংবিধান মেনে মোদীর শপথ –Oxymoron, ফ্রিডম অফ স্পিচ –Oxymoron, স্বাধীন নিরপেক্ষ মিডিয়া –Oxymoron, সাংবাদিক অর্ণব গোস্বামী –Oxymoron। তাই ওস্তাদ বলেছেন, রাষ্ট্রের মাথায় Moron-রা বসলে, Moron তাড়াতে, হেঁটে লড়তে হবে, নেটে লড়তে হবে, Oxymoron-এও লড়তে হবে।