সারা পৃথিবী জুড়ে জলস্তর কমছে, বাড়ছে দূষণের মাত্রা । সম্প্রতি বিশ্বের ৯২টি দেশের ১ হাজার ১০০ জল-গবেষক (যাঁরা মূলত ভূগর্ভের জল ও পরিশুদ্ধ জল সরবরাহ নিয়ে কাজ করেন) এক বিবৃতিতে বলেছেন, ‘‘বিশ্বের যেখানে যেখানে এখনও যথেষ্ট পরিমাণ ভূগর্ভস্থ জল সঞ্চিত রয়েছে, সেখানে প্রতি দিন এত বেশি পরিমাণ জল তোলা হচ্ছে, ফল হচ্ছে মারাত্মক। ভূগর্ভস্থ জলের ভাণ্ডারে টান পড়ছে, তেমনই সব মানুষের কাছে পরিশুদ্ধ জল পৌঁছে দেওয়াটা কঠিন হয়ে পড়ছে। পাশাপাশি বাড়ছে ভূগর্ভস্থ জলের দূষণও’’।
বিবৃতিতে গবেষকেরা মনে করিয়ে দিয়েছেন, বিশ্বের পানযোগ্য জলের ৯৯ ভাগই জোগান দেয় ভূগর্ভে সঞ্চিত থাকা জল। সেই জলের ভাণ্ডারে টান পড়লে, কিংবা তা দূষিত হতে থাকলে, যেমন বাস্তুতন্ত্রের উপরে প্রতিকূল প্রভাব পড়বে, তেমনই ধাক্কা খাবে জনস্বাস্থ্য আন্দোলন।
ভারতের ক্ষেত্রে এই বিবৃতি কতটা প্রাসঙ্গিক? বিবৃতিতে সই করা জল-গবেষকদের এক জন খড়্গপুর আইআইটি-র ভূ-পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক অভিজিৎ মুখোপাধ্যায়। তিনি বলছেন, ‘‘বিশ্বে এক সময় ভূগর্ভস্থ জলের ভাণ্ডার ছিল ভারত। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে অনিয়ন্ত্রিত ভাবে সেই জল তুলতে তুলতে আমরা এমন অবস্থায় এসে পৌঁছেছি, বেশ কয়েকটি এলাকায় সারা বছর ভূগর্ভস্থ জল মেলে নামমাত্র। প্রাচুর্য থেকে এখন সেখানে খরা’’। গত বছর তামিলনাড়ুতে জলের হাহাকার তার অন্যতম প্রমান।
ভারতের ভূগর্ভস্থ জলের অবস্থাটা এখন কেমন, পরিষ্কার তুলে ধরা হয়েছে ‘প্রসিডিংস অব ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল অ্যাকাডেমি অব সায়েন্স’ জার্নালের সাম্প্রতিকতম সংখ্যায় অভিজিৎবাবুর গবেষণাপত্রে। বলা হয়েছে, বিশ্বের স্থলভূমির মাত্র দুই শতাংশ ভারতে থাকলেও, বিশ্বের জনসংখ্যার এক-পঞ্চমাংশ হল ভারতের জনসংখ্যা। তাই ভূগর্ভস্থ জলের উপরে চাপ এখানে স্বাভাবিক নিয়মেই বেশি। ভারতে যে পরিমাণ জল ভূগর্ভ থেকে তোলা হয়, তার পরিমাণ চিন এবং আমেরিকায় তোলা ভূগর্ভের জলের মিলিত পরিমাণের চেয়ে বেশি। একটি রিপোর্ট উদ্ধৃত করে ওই নিবন্ধে বলা হয়েছে, ২০১১ সালে বিশ্বে ভূগর্ভ থেকে যত জল তোলা হয়েছে, তার ২৫%-ই তোলা হয়েছে ভারতে। ওই নিবন্ধে বলা হয়েছে, ভারতে ভূগর্ভস্থ জলের উত্তোলন এবং ভূগর্ভে মোট জলের পরিমাণের অনুপাত ০.৮, অর্থাৎ, ভূগর্ভে যে পরিমাণ জল মজুত থাকছে, তার শতকরা ৮০ ভাগই তুলে নেওয়া হচ্ছে।
সেই জল যাচ্ছে কোথায়? বিভিন্ন গবেষণার সূত্র ধরে জানা যাচ্ছে, বিশ্বে সেচযুক্ত যত কৃষিজমি রয়েছে, তার ৩০%-ই ভারতে। সেচের একটা বড় অংশ আসছে ভূগর্ভের জলের ভাণ্ডার থেকে। এর পাশাপাশি, সারা দেশে যে পরিস্রুত পানীয় জল সরবরাহ করা হয়, তার ৭০% আসে ভূগর্ভ থেকে। পরিস্থিতি আরও খারাপ হচ্ছে নিকাশি জল ভূগর্ভের জলের সঙ্গে মিশে যাওয়ায়। এ ছাড়া রয়েছে ভূতাত্ত্বিক কারণে আর্সেনিক এবং ফ্লুয়োরাইড পানীয় জলের সঙ্গে মিশে যাওয়ায়। ভূগর্ভের জল যত তোলা হচ্ছে, আর্সেনিক ও ফ্লুয়োরাইড পানীয় জলে মিশে যাওয়ার প্রবণতা তত বাড়ছে।
এর সাথে যোগ হয়েছে জল দূষণের সমস্যা। এক সরকারি রিপোর্টে বলা হয়েছে দেশের ৬০% জেলার জল দূষিত। জল সম্পদ মন্ত্রণালয় এই সংক্রান্ত এক রিপোর্ট সংসদে পেশ করেছে বলে কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। সবচেয়ে উদ্বেগজনক তথ্য হলো, ভারতের মোট ৬৩৯টি জেলার মধ্যে ৩৮৫টির জলে পাওয়া গিয়েছে নাইট্রেট, যা মানবদেহের জন্য ক্ষতিকারক বলে স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা মনে করছেন।
এই তথ্য অত্যন্ত উদ্বেগজনক বলে মন্তব্য করে বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, দুষণ-প্রভাবিত জেলার সবগুলো ব্লকেই অবশ্য এই নেতিবাচক প্রভাব লক্ষ্য করা যায়নি। বিভিন্ন জেলার পরিসংখ্যান দিয়ে রিপোর্টে বলা হয়েছে, ৬৩৯টি জেলার মধ্যে ৩৮৫টির জলে নাইট্রেট ছাড়াও ১৫৮টিতে রয়েছে লবনের প্রাদুর্ভাব, ২৬৭টিতে রয়েছে ফ্লুরাইড, ৫৩টিতে আর্সেনিক ও ২৭০টিতে রয়েছে মাত্রাতিরিক্ত লোহা। এই রাসায়নিক বা ধাতু যে পরিমাণে থাকার কথা, তার থেকে অনেক বেশি পরিমাণে রয়েছে বলে রিপোর্টে জানানো হয়েছে। পানীয় জল নিয়ে যাঁরা গবেষণা করেন তাঁরা এই রিপোর্টে উদ্বিগ্ন।
জলদূষণ বলতে জলে কোন বিষাক্ত দ্রব্য অথবা দূষিত বর্জ্য পদার্থ মিশ্রণের ফলে মানব ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পরার প্রক্রিয়াকে বোঝায়।
জলদূষণ হল জলাশয়ের, উদ্যানের, নদীর, মহাসাগরের, এবং ভূগর্ভস্থ জলের দূষণ। পরোক্ষভাবে ক্ষতিকারক যৌগ জলে অপসারণ হয় তখন তা জলে মিশ্রণের ফলে মানুষের ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে উঠে, আর এটাকেই বলে জলদূষণ। যা পুরো জীববৈচিত্রকে প্রভাবিত করে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল জীবিত জীব ও উদ্ভিদ। প্রায় সব ক্ষেত্রেই এই প্রভাবটি কেবলমাত্র পৃথক প্রজাতি এবং জনসংখ্যার জন্যই যে ক্ষতিগ্রস্ত তা নয়, বরং প্রাকৃতিক অন্যান্য উপাদানসমূহ ও প্রভাবিত হচ্ছে।
এটি প্রমাণিত হয়েছে যে জলে দূষণ বিশ্বজুড়ে মৃত্যু এবং রোগের প্রধান কারণ। শুধু মাত্র জল দূষণের কারণেই প্রতিদিন বিশ্বে প্রায় ১৪০০ এরও বেশি লোকের মৃত্যু হয়। উন্নয়নশীল দেশগুলোতে জল দূষণ একটি তীব্র সমস্যা। আরেক দিকে উন্নত দেশগুলিও দূষণ সমস্যাগুলির সাথে সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে।
জল দূষকের শ্রেণিবিভাগ
জল যা দ্বারা দূষিত হয়, তাকে প্রকৃতির ওপর ভিত্তি করে দু’ভাগে ভাগ করা যায়; যথা-
(১) তরল বর্জ্য পদার্থ (যেমন- মূত্র, বিভিন্ন প্রকার কীটনাশক, এসিড, পারদ ইত্যাদি) ও (২) কঠিন বর্জ্য পদার্থ (যেমন- বিভিন্ন প্রকার লবণ, ধাতব পদার্থ, বিভিন্ন প্রকার সার ইত্যাদি)।
আবার, পচন ক্ষমতার ওপর ভিত্তি করে দূষককে দুভাগে ভাগ করা যায়; –
(১) পচনশীল বর্জ্য (যেগুলো বিয়োজক দ্বারা বিয়োজিত হয়ে পরিবেশে ফিরে যেতে পারে, যেমন- উদ্ভিদ ও প্রাণীর মৃত দেহ, প্রাণীর মলমূত্র ইত্যাদি) এবং (২) অপচনশীল বর্জ্য (যেগুলো বিয়োজিত হয়ে পরিবেশে ফিরে যেতে পারে না, যেমন- ডিডিটি)।
এছাড়া দূষকের উৎসের উপর ভিত্তি করে দূষককে দু’ভাগে ভাগ করা যায়; যথা-
(১) প্রাকৃতিক দুষক ও (২) মনুষ্যসৃষ্ট দূষক।
দূষকের উৎস, স্বভাব, প্রকৃতিতে এদের প্রভাব ইত্যাদির ওপর ভিত্তি করে জল দূষককে নিম্নলিখিতভাবে ভাগ করা যায় :
১. পরিপোষক জৈব : মানুষ ও প্রাণীর বর্জ্য, লিটার, তলানি। অজৈব : নাইট্রোজেন, ফসফরাস, ডিটারজেন্ট।
২. রোগজীবাণু সৃষ্টিকারী ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস, প্রোটোজোয়া, প্যারাসাইট ইত্যাদি।
৩. বিষাক্ত জৈব দূষক কীটপতঙ্গ নাশক, পলিক্লোরিনেটেড ফিনাইল, পলিসাইক্লিক অ্যারোমেটিক, হাইড্রোকার্বন, পেট্রোলিয়াম ইত্যাদি।
৪. বিষাক্ত অজৈব দূষকধাতব লবণ, পারদ, সীসা, তামা, ক্যাডিয়াম, ক্রোমিয়াম, আর্সেনিক, নাইট্রেট, নাইট্রাইট ইত্যাদি।
এই রাসায়নিক বা ধাতু যে পরিমাণে থাকার কথা, তার থেকে অনেক বেশি পরিমাণে রয়েছে বলে রিপোর্টে জানানো হয়েছে।
পানীয় জল নিয়ে যাঁরা গবেষণা করেন তাঁরা এই রিপোর্টে উদ্বিগ্ন। সেন্টার ফর সায়েন্স অ্যাণ্ড এনভায়রনমেন্টের জল বিষয়ক দফতরের প্রধান জেকব বলেন, “পানীয় জল পাওয়ার জন্যে মানুষকে মাটির যতো নিচে যেতে হবে ততোই বেশি দূষিত জল পান করতে হবে কারণ মাটির নিচে জলে ধাতুর পরিমান বেশি জল সেখানে বেশিদিন ধরে রয়েছে বলেই এটা হচ্ছে”। আর এক জন জল গবেষক হিমাংশু ঠক্করের বক্তব্য, “শিল্পপতিরা জল পরিশোধন করে তা নদীতে ফেলেন না , এতে তাদের খরচ বেড়ে যাবে এই অপরিশোধিত জল মাটির নিচে গিয়েই বিপত্তি ঘটাচ্ছে সরকারও কিছু বলছে না, কারণ সরকারের ভয় রয়েছে এতে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার কমে যাবে কারণ জল পরিশোধন করাতে শুরুর দিকে কারখানার ক্ষতি হবে”।
তবে ৩৮৫টি জেলা দূষিত জল পান করছে বলেই সব ব্লকের মানুষ তা পান করছেন এমন নয়, বক্তব্য বিশেষজ্ঞদের তাঁরা মনে করেন এই জেলাগুলির কিছু ব্লকের জল দূষিত বাকীগুলোর জল এখনও নিরাপদ। কেন্দ্রীয় সরকার এ বিষয়ে উদাসীন, সরকারের তরফে কোন মন্ত্রকই বিষয়টি নিয়ে কোনও নির্দিষ্ট মন্তব্য করেনি।
ভূগর্ভস্থ জল অপচয়ের ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গের নাম তালিকার প্রথম দিকেই। বেআইনি ভাবে পাম্প বসিয়ে দেদার মাটির নীচের জল তোলার অভিযোগ উঠছে বিভিন্ন জেলার নানা প্রান্তে। ভূগর্ভের জল তুলে ব্যবসা করার অভিযোগে সম্প্রতি দুর্গাপুর মহকুমার একাধিক জায়গায় অভিযান চালিয়ে বেশ কিছু পাম্পও বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে। মাঝে-মাঝে প্রশাসনিক অভিযান হলেও এই প্রবণতায় রাশ টানা যাচ্ছে না বলে দাবি আসানসোল ও দুর্গাপুরের বহু বাসিন্দার।
শহর লাগোয়া গ্রামীণ এলাকাগুলিতে বেআইনি ভাবে জল বিক্রির ব্যবসা গজিয়ে উঠেছে বলে অভিযোগ উঠছে বেশ কিছু দিন ধরে। কয়েকটি এলাকার বাসিন্দারা অভিযোগ করেন, জমিতে সেচ দেওয়ার নাম করে পাম্প বসিয়ে সারা বছর ধরে মাটির নীচের জল তোলে কিছু লোকজন। ট্যাঙ্কারে ভরে ট্রাক্টরে করে শহরের বহু সংস্থা, অফিস, এমনকি কিছু আবাসনেও জল বিক্রি করা হয় এক-দেড় হাজার টাকায়। দুর্গাপুর মহকুমায় শোভাপুর, বিজড়া, ধবনী, রাজবাঁধ-সহ নানা এলাকায় বেআইনি এই ব্যবসার অভিযোগ উঠছে। বাসিন্দাদের একাংশের অভিযোগ, এ ভাবে মাটির নীচের জল তুলে ফেলায় গ্রীষ্মে এলাকার কুয়ো ও টিউবওয়েলে জল পেতে সমস্যা হয়।
শহরে এই ধরনের জলের ট্যাঙ্কার ধরার দাবি জানিয়েছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। যদিও প্রশাসনের দাবি, উৎসে অভিযান চালানো বেশি জরুরি। ২০১৯-এর জুলাই মাসে বিজড়া ও ধবনী গ্রামের মাঝে জমি থেকে বেশ কিছু পাইপ, পাম্প ও যন্ত্রপাতি ব্যবহারের খবর আসে। ওই সময়েই কাঁকসার বাঁশকোপায় দু’টি জায়গায় অভিযান চালিয়ে পাম্প বাজেয়াপ্ত ও পাইপ ‘সিল’ করা হয়। স্থানীয় একটি বেসরকারি ইস্পাত কারখানায় দেদার মাটির নীচের জল তোলা হচ্ছে বলে বাসিন্দারা অভিযোগ তোলে।
হুগলিতেও ছ’টি ব্লকের ভূগর্ভস্থ জলস্তর মারাত্মক নেমে গিয়েছে। তার মধ্যে শহরাঞ্চল এবং গ্রামীণ এলাকা— দুই-ই আছে। কয়েক বছর আগে ভূ-জল বোর্ড হুগলিতে যে সমীক্ষা চালিয়েছিল, তাতে শুধুমাত্র গোঘাট-২ এবং বলাগড় ব্লকের ভূগর্ভস্থ জলস্তর নেমে যাওয়ার ইঙ্গিত মিলেছিল। বলাগড়ে ভূগর্ভস্থ জলের আর্সেনিক সমস্যাও দীর্ঘদিনের। সম্প্রতি সমীক্ষকেরা দেখেন, হুগলিতে জলস্তর নেমে গিয়েছে আরও কিছু ব্লকে। তার মধ্যে ছ’টি ব্লকের অবস্থা শোচনীয়। এর মধ্যে চণ্ডীতলা-১ ব্লকে আর্সেনিক পাওয়া গিয়েছে বলে জানান অন্যতম সমীক্ষক অলোক বন্দ্যোপাধ্যায়।
সমীক্ষকেরা সবচেয়ে বেশি উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন শ্রীরামপুর-উত্তরপাড়া ব্লক নিয়ে। কারণ এই ব্লকে চাষ কম হয়। ফলে, ভূগর্ভস্থ জলের ব্যবহার কম হওয়ার কথা। কিন্তু বাস্তবে মিলেছে উল্টো ছবি। অম্লানজ্যোতিবাবু বলেন, ‘‘এই ব্লকটিতে নিয়ন্ত্রণহীন ভাবে প্রতিটি আবাসনে মাটির জল তোলা হচ্ছে। ফলে, জলস্তরের মারাত্মক ক্ষতি হচ্ছে। এই ব্লকের পুরসভাগুলিকে নতুন আবাসনের অনুমতি দেওয়ার ক্ষেত্রে জল তোলা নিয়ন্ত্রণের কথা ভাবার পরামর্শ দিচ্ছি আমরা”।
শ্রীরামপুর-উত্তরপাড়া ছাড়া বাকি পাঁচ ব্লকে অবশ্য ধান চাষ হয়। তাতে আধুনিক পদ্ধতিতে স্রেফ মাটিয়ে ভিজিয়ে চাষ করায় জোর দিচ্ছে ভূ-জল বোর্ড। ভুট্টার মতো চাষে (জলের খরচ কম) চাষিদের উৎসাহিত করতেও জোর দেওয়া হচ্ছে।
এবার আসা যাক উত্তর ২৪ পরগনার কথায়। এই জেলায় বেশির ভাগ ব্লকেই পানীয় জলে মাত্রাতিরিক্ত আর্সেনিক রয়েছে বলে স্বাস্থ্য দফতর সূত্রের খবর। জেলায় আর্সেনিক-দূষণের জেরে রোগে আক্রান্ত লক্ষাধিক। মৃতের সংখ্যা আড়াইশোর কাছাকাছি। অভিযোগ, সেই সুযোগটাই কাজে লাগাচ্ছেন অসাধু জল ব্যবসায়ীরা। সরকারি নির্দেশিকা অমান্য করে পাম্পের সাহায্যে মাটির তলা থেকে প্রতিদিন গ্যালন গ্যালন জল তুলে বোতলে ভরে চলছে বিক্রি। দমদম, মধ্যমগ্রাম, বারাসত, দত্তপুকুর, ব্যারাকপুর, কদম্বগাছি, আমডাঙা, বসিরহাট, বনগাঁ ও দেগঙ্গা মিলে দেড় হাজারের মতো এমন অবৈধ কারখানা চলছে রমরমিয়ে। সেই জলে থেকে যাচ্ছে আর্সেনিক ছাড়াও নানা জীবাণু।
মাটির নীচ থেকে জল তুলে তা সরাসরি বোতলে ভরে পানীয় জল হিসেবে বিক্রি করাটা পুরোপুরি আইনবিরুদ্ধ। এমন কারখানার অনুমতিও দিতে পারে না পুরসভা কিংবা পঞ্চায়েত। কিন্তু এলাকায় গিয়ে দেখা গিয়েছে , সমস্ত নিয়মকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে , পুরসভা বা পঞ্চায়েতের ট্রেড লাইসেন্স নিয়ে ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠেছে জল বোতলে ভরার কারখানা।
বারাসতের নেতাজিপল্লিতে পরপর রয়েছে এমন চারটি কারখানা। ভিতরে ঢুকে দেখা যায়, ভূগর্ভ থেকে জল তুলে একটি যন্ত্রে সামান্য পরিশোধন করে এক লিটারের বোতল ও ২০ লিটারের প্লাস্টিকের জারে ভরার কাজ চলছে। সেই জল পৌঁছে যাচ্ছে ঘরে ঘরে। অভিযোগ, পুলিশ ও প্রশাসনের একাংশের সঙ্গে যোগসাজশেই পানীয় জল নিয়ে অবাধে চলছে এমন ব্যবসা।
জলের এই অবৈধ ব্যবসা যাঁরা করছেন, সেই কারখানা মালিকদের কেউই ট্রেড লাইসেন্স ছাড়া অন্য কোনও প্রয়োজনীয় ছাড়পত্র বা লাইসেন্স দেখাতে পারেননি। জলের বিশুদ্ধতা যাচাই না করে তা পানীয় জল হিসেবে বিক্রি যে ঘোরতর অন্যায়, সে কথা অবশ্য স্বীকার করছেন মালিকেরাও। তাঁদের পাল্টা যুক্তি, ‘‘সরকার যদি বিশুদ্ধ পানীয় জল সরবরাহের ব্যবস্থা করতে পারত, তা হলে তো কেউ আমাদের জল কিনে খেত না। এত কারখানা চলতও না”।
গবেষকদের মতে, যে-সব রাজ্য মাটির তলা থেকে সর্বাধিক জল তুলছে, তাদের মধ্যে পশ্চিমবঙ্গ রয়েছে প্রথম সারিতে। সেই জল মাটির তলায় পৌঁছে দেওয়ার কাজ এখনই শুরু করতে হবে। না হলে কিন্তু ভবিষ্যতে ভুগতে হবে পশ্চিমবঙ্গকেও। মহারাষ্ট্র, গুজরাত, বিহার, অন্ধ্রপ্রদেশ ভূগর্ভে জল ফিরিয়ে দেওয়ার প্রকল্পগুলি শুরু করেছে সেখানে জল নিঃশেষ হয়ে যাওয়ার পরে। সেই অবস্থার জন্য পশ্চিমবঙ্গকে বসে থাকলে হবে না। মনে রাখতে হবে, এখানে ভূগর্ভস্থ জলে মিশে রয়েছে আর্সেনিক এবং ফ্লুয়োরাইড। তাই পশ্চিমবঙ্গের সঙ্কট অন্যদের থেকে বেশি।