Site icon CPI(M)

78 YEARS OF HELL

সৌরভ চক্রবর্তী

আজ নাগাসাকি দিবস।ভোর তিনটে ৪৭ মিনিটে বিশ হাজার টন টিএনটির ‘ফ্যাট ম্যানকে’  বি 29 যুদ্ধবিমান ‘বক্সকার’ কে নিয়ে, টিনিয়ান দ্বীপ থেকে উড়তে  শুরু করলো চার্লস স্যুইনি। প্রাথমিক লক্ষ্য স্থল কোকুরা।  ঘন মেঘে ঢাকা আকাশ, লক্ষ্যবস্তুকে ঠাওর করা যাচ্ছে না। ৪৫ মিনিট কোকুরার আকাশে চক্কর কেটে চালু হলো প্ল্যান – বি।বিমান উড়ে চলল নাগাসাকি। সেখানেও মেঘলা আকাশ। দৃষ্টিগোচর হচ্ছে না লক্ষ্যবস্তু। শেষে এক ঝলক চোখে পরলো মিৎসুবিশি কারখানা। ফেলে দেওয়া হলো বোমা। এগারোটা বেজে দু মিনিটে নাগাসাকিতে নেমে এসেছিল নরক। আশি হাজার মানুষ মারা গিয়েছিলেন। যারা আগুনে পুড়ে মারা গেলেন না, তারা তেজস্ক্রিয় বিকিরণের শিকার হয়ে বেঁচে রইলেন। এদের বলা হয় হিবাকুশা। এমনকি মায়ের পেটে যারা ছিলেন এবং হাইপো সেন্টারের ২ কিলোমিটারের মধ্যে সন্তানসম্ভবা মা  ছিলেন বা দুই সপ্তাহের মধ্যে গিয়েছিলেন, তারা সবাই হিবাকুশা। জাপান সরকারের হিসেবে নাগাসাকিতে এই সংখ্যা এক লাখ ৮৯ হাজার ১৬৩ জন। হিরোশিমায় তিন লক্ষ ২৮ হাজার ৯২৮  জন, সর্বমোট ৫ লক্ষ ২০ হাজার মানুষ বিকৃত শরীর, ক্যান্সার রোগ এবং তার ঝুঁকি, অন্যান্য রোগ নিয়ে দুর্বিষহ কষ্ট নিয়ে  জীবনাতিপাত করা মানুষগুলোর নাম হিবাকুশা।

হিরোশিমাতে মৃত্যু হয়েছিল এক লক্ষ ৪০ হাজার মানুষের।

১৫ হাজার টন টিএনটির ইউরেনিয়াম বোমা লিটল বয়, ৮ টা বেজে ১৫ মিনিটে মাটি থেকে ১৯০০০ফুট উপরে বিস্ফোরিত হয়েছিল, তৎক্ষণাৎ তাপমাত্রা উঠেছিল ৬০০০ ডিগ্রী সেলসিয়াস। সূর্য্যপৃষ্ঠের তাপমাত্রার সমান।

দেড় কিলোমিটারের মধ্যে কিছু ছিল না। মানুষ বাষ্পীভূত হয়ে স্রেফ উবে গেছে, পড়ে আছে শুধু  জলছাপ। একটা স্কুলের ৮০ শতাংশ বাচ্চাই মৃত। ১২০০ মিটারের এক আগুনের গোলা দৌড়োচ্ছে। প্রতি বর্গ ইঞ্চিতে ৫ পাউন্ড এর চাপ। কল্পনাতীত তাপে কাঠ কয়লার মতো পুড়েছে মানুষ। তেজস্ক্রিয়তায় শরীরের চামড়া খসে পড়েছে।

বুকফাটা তৃষ্ণা!

যুক্তিহীন নারকীয়তা

সত্যিই প্রয়োজন ছিল এ বীভৎসতার? এটা ঠিক ১৯৩৯ সালের ২রা আগষ্ট প্রখ্যাত বিজ্ঞানী  লিও জিলার্ড, এবং ইউজিন উইগনারের অনুরোধে আইনস্টাইন আমেরিকার তৎকালীন রাষ্ট্রপতি রুজভেল্ট কে চিঠি লিখে বলেছিলেন যে, নাজি জার্মানি পরমাণু বোমা বানিয়ে ফেলতে পারে, তারা পরমাণু জ্বালানি ইউরেনিয়াম খনির দখল নিয়েছে। এই অবস্থায় আমেরিকার পরমাণু গবেষণা শুরু করা উচিত। এটা ঠিক এ চিঠির পরেই রুজভেল্ট ব্যবস্থা নিয়েছিলেন যার পরিণতিতে বোমা বানানোর ম্যানহাটান প্রকল্প।

কিন্তু কোন তাগিদ থেকে এই চিঠি লিখেছিলেন আইনস্টাইন?  লিখেছিলেন তার মতো অজস্র দিকপাল ইহুদি ঘরছাড়া বিজ্ঞানীদের হয়ে যারা জার্মানি, ইতালি, হাঙ্গেরি থেকে পালিয়ে এসে জড়ো হয়েছিলেন আমেরিকায় কেউবা ব্রিটেনে। ফ্যাসিবাদের ভয়ঙ্কর রূপ তারা প্রত্যক্ষ করেছিলেন তাই ফ্যসিস্টদের হাতে পরমাণু বোমা আসলে পৃথিবীর মানবতা নিশ্চিহ্ন হবে এ আশঙ্কা বিজ্ঞানীদের ছিল।

জেমস ফ্রাঙ্ক রিপোর্ট

এটা যেমন ঠিক তেমনি, পরমাণু বোমা বানানো চলছে, তখনও ১৬ ই জুলাই ট্রিনিটি টেস্ট হয়নি, স্বনামধন্য  পদার্থ বিজ্ঞানী জেমস ফ্রাঙ্ক কমিটির প্রতিবেদনে বলা হল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জাপানের আত্মসমর্পণ কে ত্বরান্বিত করতে অস্ত্র হিসেবে যেন পরমাণু বোমা ব্যবহার না করা হয়। একা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বোমার গোপনীয়তাকে রক্ষা করতে পারবে না। অস্ত্র দৌড় বাড়বে। অন্যদের সাথে তাল মেলাতে গিয়ে দ্রুত আমেরিকাকে বোমা বানিয়ে চলতে হবে। অস্ত্র প্রতিযোগিতা এবং পারস্পরিক ধ্বংসের নিশ্চয়তা এই দুটি বিষয়ের ভবিষ্যৎবাণী অক্ষরে অক্ষরে ফলে গিয়েছিল ‘ কোল্ড ওয়ার ‘এর সময়। রিপোর্ট বলেছিল, পরমাণু বোমা ব্যবহার নয়। তারা প্রস্তাব করেছিলেন, হয় এই ‘নতুন অস্ত্র’ রাষ্ট্রসঙ্ঘের প্রতিনিধিদের সামনে কোনো নির্জন দ্বীপে বা মরুভূমিতে প্রদর্শন করা হোক অথবা এই পরমাণু বোমাকে যতদিন সম্ভব গোপনে রেখে দেওয়া হোক। রিপোর্টে  স্বাক্ষর করেছিলেন সেই লিও জিলার্ড, যিনি আইনস্টাইনকে অনুরোধ করেছিলেন রুজভেল্ট কে চিঠি লেখার জন্য যাতে  আমেরিকা পরমাণু গবেষণা শুরু করে। কি হতে যাচ্ছে ভেবে বুক কেঁপে উঠেছিল জিলার্ড  সহ অন্যান্য বিজ্ঞানীদের। রিপোর্টে চেয়ারম্যান জেমস ফ্রাঙ্ক ছাড়াও স্বাক্ষর করেছিলেন ডোনাল্ড জে হিউজেস, জে জে  নিক্সন, ইউজিন রাবিনোবিচ,যিনি এই  রিপোর্ট লিখেছিলেন, গ্লেন টি সীবর্গ, জে সে স্টার্নস।

Alienated হলেন বিজ্ঞানীরা

না মানা হয়নি বাঘ তখন রক্তের নেশায় পাগল। যদি তা হ’তো, হয়তো দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এ পৃথিবীর চেহারাটা অন্যরকম হ’তো। এখান থেকেই বিজ্ঞানের ফসল আর বিজ্ঞানীদের হাতে থাকল না alienated হ’লো। রাজনীতি এই ফসল ছিনিয়ে নিল। মানবতা পদপিষ্ট হলো।

ট্রিনিটি টেস্ট

এরপরেও সুযোগ ছিল। নিউ মেক্সিকো সিটির  আলমাগার্ডোতে ১৬ ই জুলাই ১৯৪৫,  বিশ্বের প্রথম পরমাণু বোমা বিস্ফোরণের পরীক্ষা হল। বিস্ফোরণের পর ৪০ হাজার ফুট উপরে উঠল ‘মাশরুম মেঘ।’ আধ মাইল ব্যাস চওড়া  এবং ২৫ ফুট গভীরতার বিশাল গহবর তৈরি হ’ল। ৮০ কিলোমিটার দূর থেকে বিস্ফোরণ দেখা গেল।২৯০ কিলোমিটার দূরে নিউ মেক্সিকোর গ্যালপে মাটি কেঁপে ওঠা অনুভূত হ’ল। বিজ্ঞানীরা বুঝলেন কি বীভৎস ধ্বংসাত্মক এক মারণ অস্ত্র তারা তৈরি করেছেন।

২০ হাজার টন টিএনটি বোমার ধ্বংসক্ষমতা দেখে পরমাণু বোমার জনক বিজ্ঞানী রবার্ট ওপেনহাইমার বললেন ” Now I am become death, destroyer of the world.”

ট্রিনিটির ডিরেক্টর পদার্থবিজ্ঞানী কেনেথ ব্রিজ বললেন, ” Now we are all sons of bitches. “

এবারেও মত তৈরি হয়েছিল বিজ্ঞানীকূলে, এ বোমা ব্যবহার না করার জন্য কিন্তু বাঘ তখন রক্ত চাটার স্বপ্নে আর বিশ্বকে প্রধানত করার স্বপ্নে মশগুল।

বিশ্ব যুদ্ধ কার্যত শেষ

অ্যাক্সিস পাওয়ারের এক স্তম্ভ ইতালি। ক্ষমতাচ্যুত হয়েছে মুসোলিনি। ইতালি আত্মসমর্পণ করেছে ২৮ শে সেপ্টেম্বর ১৯৪৩ সালে। হিটলারের মৃত্যু হয়েছে ৩০শে  এপ্রিল ১৯৪৫, জার্মানির আত্মসমর্পণ ৯ই মে ১৯৪৫। জাপান ধুঁকছে। জার্মানির পটসডাম এ  ১৭ ই জুলাই থেকে ২রা আগস্ট অনুষ্ঠিত হয়েছে বিশ্বযুদ্ধোত্তর পৃথিবী নিয়ে ট্রুম্যান, স্তালিন,চার্চিলের বৈঠক। মানে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ কার্যত শেষ। শুধু জাপানের আত্মসমর্পণ ঘোষণার পর যুদ্ধ শেষ হবার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা বাকি। এই পরিপ্রেক্ষিতে ৬ ই আগস্ট  এবং ৯ ই আগস্ট নরক তৈরি করার ঘৃণ্য অপরাধ সেদিন আমেরিকা করেছিল, বিশ্বের সামনে নরকই প্রদর্শন করার জন্য। এই নরকের ত্রাস দেখিয়ে পটসড্যামের বৈঠকে স্তালিন কে জব্দ করা তো বটেই তার সাথে আরও বড় জিভ লকলকে বাসনা, দুনিয়ার অধীশ্বর হওয়ার বাসনা।

পৃথিবী বহুবার ধ্বংস হতে পারে

যুদ্ধপরবর্তী সময়ে আমেরিকা তার লুন্ঠন বৃত্তি চরিতার্থ করার জন্য পরমাণু বোমার উপরেই ভরসা রেখেছে। জেমস ফ্রাঙ্ক রিপোর্ট  সত্যি হয়েছে। আজ নটি দেশ পরমাণু অস্ত্রধর।

পৃথিবী কে অনেকবার ধ্বংস করার মত পরমাণু অস্ত্র ভান্ডার মজুদ এ বিশ্বে।

সারা পৃথিবীতে মোট পরমাণু অস্ত্র ১২,৭০৫ টি। রাশিয়া ৫৯৭৭ টি, আমেরিকা ৫৪২৪ টি,  চীন ৩৫০ টি, ফ্রান্স ২৯০ টি, ব্রিটেন ২২৫ টি, পাকিস্তান ১৬৫ টি,ভারত ১৬০,ইস্রায়েল ৯০ টি,  উত্তর কোরিয়া ২০ টি।

অস্ত্র নিবারণ চুক্তিতে আমেরিকা বিশ্বাস করে না। সে সিটিবিটি (কম্প্রিহেনসিভ টেস্ট ব্যান ট্রিটি) তে  স্বাক্ষর করেনি। টিপিএনডব্লু ( ট্রিটি অন প্রহিবিশন অফ নিউক্লীয়ার ওয়েপন)।  যদিও সে শেষোক্তটিতে পরমাণু শক্তিধর দেশগুলোর কেউই স্বাক্ষর করেনি। বুদ্ধের দেশ ভারতবর্ষ সিটিবিটি এবং টিপিএনডব্লু তে ভারত স্বাক্ষর করেনি। তাই পরমাণু অস্ত্র মুক্ত পৃথিবী অন্তত আপাতত হচ্ছে না। তবে একদিন এ বিশ্ব পরমাণু অস্ত্রমুক্ত হবে এই বিশ্বাসই জাগরুক থাকবে।

ট্রুম্যান ডকট্রিন – কোল্ড ওয়ার

হিরোশিমা নাগাসাকি বোমা বিস্ফোরণের পর লক্ষ্য চিতার আগুন তখনও নেভেনি, ট্রুম্যান ভাষণ দিয়ে বলেছিলেন, “When you have to deal with a beast, you have to treat him as a beast. It is most regrettable but nevertheless true.”

এই ভাষায় যে রাষ্ট্রপতি কথা বলে মানবিকতার নয়, জান্তবতারই প্রতিনিধিত্ব করে। তাই যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে আমেরিকা, ট্রুম্যানের দর্শনই আত্মস্ত করলো,যার নাম ট্রুম্যান ডকট্রিন। শুরু হয়েছিল ‘ কোল্ড ওয়ার ‘ বা শীতল যুদ্ধ।কি সেই ডকট্রিন?

মার্কিন কংগ্রেসে  ভাষণ দিয়ে হেনরি ট্রুম্যান বলেছিলেন, “It must be the policy of the United States of America to support free peoples who are resisting attempted subjugation by armed minorities or by outside pressures. “

তার মানে কি দাঁড়ালো?  না, নিজের পছন্দ মতো সরকার নাহলে সেই সরকার বিরোধীদের মদত করা। ঐতিহাসিক এরিক ফনার লিখেছেন যে, এই ডকট্রিন হ’ল, ” Set a precedent American assistance to anticommunist regimes throughout the world , no matter how undemocratic, and for the creation of a set of global military alliances directed against the Soviet Union.”

এই বিবৃতির পরেই শুরু হয়েছিল ‘ কোল্ড ওয়ার ‘, চলেছিল ১৯৯১ এ সোভিয়েত রাশিয়ার পতনের সময় পর্যন্ত। লাতিন আমেরিকা, এশিয়া, আফ্রিকার দেশে দেশে নির্বিচারে নিধন করা হয়েছিল কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যদের। কমিউনিস্ট  সরকারগুলোকে উৎখাত করে পুতুল সরকার, ড্রাগ ব্যারণদের  বসানো হয়েছিল তখত্ এ।  তাতে কখনো সিআইএ কখনো নেটোর মাধ্যমে।  দিন বদলাচ্ছে। লাতিন আমেরিকায় ফিরছে বামপন্থীরা। বলিভিয়া, পেরু,হন্ডুরাস,চিলি, কলম্বিয়াতে সরকারে আসীন তারা। আফগানিস্তান থেকে আমেরিকা পালিয়েছে! রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে ন্যাটো নাক গলাতে পারছে না! পাল্টে যাচ্ছে বিশ্বের ভূ-রাজনীতি। বিশ্বের অবস্থা ভালো নয়, তবু আমেরিকার তর্জনী থাকবে আর বিশ্বে পরমাণু অস্ত্রমুক্ত হবে! যুদ্ধ নয় শান্তি প্রতিষ্ঠিত হবে! তা হবে সোনার পাথর বাটি।

Spread the word