Site icon CPI(M)

ভারতের সংবিধান ও সাংবিধানিক মূল্যবোধের উপরে আক্রমণ – বিকাশ রঞ্জন ভট্টাচার্য…

২৬ জানুয়ারি ২০২১, মঙ্গলবার


ভারতীয় সংবিধান অর্জনের পিছনে এক দীর্ঘ রাজনৈতিক সংগ্রাম কাজ করছে। ব্রিটিশ সাম্রাজ্য বাদের বিরুদ্ধে সমাজের সর্বস্তরের মানুষ একত্রিত হয়েছিল, কংগ্রেস দল সামগ্রী ভাবে ছিল ব্রিটিশ বিরোধী এক সমন্বয় মঞ্চ। উদারপন্থী গণতান্ত্রিক মনোভাবাপন্ন গোষ্ঠী যেমন ছিল তেমন বামসমাজতন্ত্রিক শক্তি যুক্ত ছিল। এই সমন্বিত লড়াই এর ফলে ২ য় বিশ্ব যুদ্ধের পর ব্রিটিশ শক্তি তাদের পার্লামেন্টে আইন করে ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। এই প্রসঙ্গে সেই সময় চার্চিল এর একটি মন্তব্য গ্রহণযোগ্য

১৯৩০ সালে চার্চিল যেই মন্তব্য করেছিলেন –
” To abundant India to the rule of brahmins would be an act of cruel and wicked negligence. If British left then the entire gamach of public service, the judiciary, medical, railway a and public works Department would perish and India will fall back quite rapidly through the centuries into the barbarism and privatisation of the middle ages”




সাম্রাজ্যবাদী শাসকের উপনিবেশে সম্পর্কে চিন্তা এবং মন্তব্য যথেষ্ট আপত্তি কর এবং ওই ঘৃণাকে ধুলি স্বাদ করে দেশের মানুষ যখন তাদের হাতে ক্ষমতা পেলেন তখন সেই সন্ধিক্ষণে ভারতবর্ষ কি ভাবে শাসিত হবে তার রূপরেখা নির্ধারণের জন্য সংবিধান সভা তৈরি হয় এবং ভারতীয় সংবিধান তৈরির জন্য সংবিধান সভায় দীর্ঘ আলোচনা হয়। সব থেকে লক্ষণীয় ব্যাপার ছিল যে সেই সংবিধান সভায় সর্বস্তরের মানুষের প্রতিনিধিত্ব ছিল এবং সর্ব স্তরের প্রতিনিধিদের আলোচনার মধ্যে দিয়ে সর্বসম্মতি ক্রমে ভারতীয় সংবিধান গৃহীত হয়। এ প্রসঙ্গে সংবিধানের মুখবন্ধ অত্যন্ত গুরুতবপূর্ণ। এই মুখবন্ধ হচ্ছে সংবিধানের মৌলিক চিন্তা বা প্রান ভোমরা। সংবিধানের মূল মন্ত্র হচ্ছে “আমরা ভারতবর্ষের জনগন”। ধর্ম, বর্ণ, জাতি, গোষ্ঠী, ভাষার উর্ধে উঠে ভারতীয় জনগন সংবিধান গ্রহন করেন। ভারতবর্ষের জনগন সকলের সম্মিলিত সিদ্ধান্ত হল যে ভারতবর্ষ একটি গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র। এই প্রজাতন্ত্রের লক্ষ হবে সামাজিক রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সাম্য প্রতিষ্ঠা করা। সমসুযোগ এবং সর্বোপরি ব্যক্তি মর্যাদা শুদীর্ঘদিন ধরে ভারতবর্ষের বুকে ব্রাহ্মণ্যবাদের প্রভাবে বর্ণাশ্রম আচরণে মানুষ অপমানিত হয়েছে- লাঞ্ছিত অপমানিত হয়েছে। তার বিরুদ্ধেই ব্যক্তি মর্যাদা রক্ষার রাষ্ট্রিক দায়িত্ব এক গুরুত্বপূর্ণ তাৎপর্য বহন করে ও নতুন নৈতিকতার মান স্থির করে এ প্রসঙ্গে পি এন সবালিন এর বিবৃতি প্রণিধানযোগ্য –

” we have definitely accepted the democratic process, why we have accepted it? Well for a variety of reasons. Because we think that it in the final analysis it promote the growth of human being and of society : because as we have said in our constitution we attach great value to the individual freedom; because we want the creative and adventurous spirit of man to grow. It is not enough for us merely to produce the material goods of the world we do want high standards of living but not at the cost of mans creative spirit, his creative energy, his spirit of adventure, not at the cost of all those find things of life. Which have ennobled are question of elections the questions before us is how to combine democracy wheat socialism through peaceful and legitimate means.”

আম্বেদকর

এ প্রসঙ্গে সংবিধান গ্রহণকালে আম্বেদকর এর একটি লেখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তার মতে সংবিধান গ্রহণের সঙ্গে সঙ্গে আমরা ভোটের ক্ষেত্রে সকলকে সমান করলাম কারণ প্রতি মানুষ একটি ভোট প্রদান করতে পারে কিন্তু সামাজিক ক্ষেত্রে ব্যাপক অসাম্য রইল এবং

তিনি প্রশ্ন করেছেন-“how long shelf we continue this life of contradiction how long shall we continue to deny inequality in our social and economic life? if we continue to run I eat for long we will do so only by putting our political democracy in peril”

সুপ্রিম কোর্ট

সংবিধান প্রণেতা প্রণেতারা এবং স্বাধীনতা-উত্তর রাজনৈতিক নেতারা গুটিকয়েক ব্যতিক্রম ছাড়া নতুন ভারতবর্ষের এক নতুন নৈতিকতার স্বপ্ন দেখলেন তা হল সাংবিধানিক নৈতিকতা যার মূল মন্তব্য হচ্ছে সামাজিক ও আর্থিক সমতা অর্থাৎ সমাজবাদ।

খুব সম্প্রতি কর্নাটকের বিধানসভায় টাকা দিয়ে নির্বাচিত সদস্যদের বিক্রি হওয়ার পর তাদের পদ খারিজ হবে কিনা তাতে যখন স্পিকারের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে তখন সুপ্রিমকোর্ট বলেন যে সংবিধান ভারতবর্ষেরসমাজনীতি এবং রাজনীতিতে এক নতুন নৈতিকতার জন্ম দিয়েছে যার মূল কথা আইনের অনুশাসন প্রতিষ্ঠা করা এবং সাংবিধানিক মূল্যবোধকে রক্ষা। সাংবিধানিক মূল্যবোধ রক্ষিত হবে যখন সংবিধানের যে মুখবন্ধ তাকে প্রতিষ্ঠা করা যাবে অর্থাৎ স্বাধীন চিন্তা, মত প্রকাশের অধিকার, ব্যক্তি ধর্মাচরণের অধিকার (রাষ্ট্রের নয়) রক্ষার দায়িত্ব রাষ্ট্রকে নিতে হবে। রাষ্ট্র বলতে আমরা বুঝি আইনসভা প্রশাসন এবং বিচার ব্যবস্থার সম্মিলিত রূপ।সম্প্রতিকালে স্পষ্টতই লক্ষ্য করা যাচ্ছে যে দেশের নির্বাচিত সরকার সংবিধানের মর্মবস্তু কে আঘাত করে চলেছে। রাম মন্দির সংক্রান্ত বিতর্ক এবং সে বিতর্কে প্রধানমন্ত্রী ,রাষ্ট্রপতি নির্বাচন সাংবিধানিক নৈতিকতা বিরোধী।লোকসভা ভবন নির্মাণে বৈদিক আচরণ পালন করে যে ভূমি পূজার ব্যবস্থা হল তা “আমরা ভারতীয় নাগরিক” এই মর্মবস্তু কে প্রতিষ্ঠা করে না। সরকারি খরচে একটি নির্দিষ্ট ধর্মীয় আচরণ কে প্রশ্রয় দেওয়া সংবিধান হত্যা করার শামিল।যেমন সুপ্রিম কোর্টের পক্ষে রাম রাম মন্দির তৈরীর জন্য ট্রাস্ট গঠন করতে বলা সাংবিধানিক মর্মবস্তু কে গলা টিপে হত্যা করেছে।

বর্ণাশ্রম

অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সামাজিক সাম্য ও অর্থনৈতিক সাম্য প্রতিষ্ঠার বদলে অসাম্যকে টিকিয়ে রাখার চেষ্টা হচ্ছে।জীবনের অধিকার অন্যতম মৌলিক অধিকার বিভিন্ন তথ্য সরকারি এবং বেসরকারি প্রমাণ করছে আমরা ক্রমশ ক্ষুধার্ত মানুষের সংখ্যা বাড়িয়ে চলেছি।রাষ্ট্র সেখানে মানুষের মুখে খাদ্য যোগাড় নিশ্চিত করার পরিবর্তে কৃষিকে বাণিজ্যে পরিবর্তন করার জন্য এবং ধর্মবাদীদের হস্তক্ষেপ সহজ করার জন্য কৃষি আইন আনিলেন তাও প্রচলিত সংসদীয় প্রথাকে বর্জন করে।
সংবিধানের সমতার রক্ষা করাই হচ্ছে

সরকারের মূল কর্তব্য সুপ্রিম কোর্টের মতে- “equality is a means of achieving justice the nation that equality under the constitution is based on the substantial idea of providing equal access to resources and opportunities. Social justice in other words is a matter involving the distribution of benefits and burdens”।

সংবিধানের ক্ষমতা যে অর্থ তাকে কার্যকরী করার দায়িত্ব যে প্রজাতন্ত্রের ওপর অর্পিত হয়েছে সে দায়িত্ব সরকারের পক্ষে সাংবিধানিক নৈতিকতা ।এই নৈতিকতার পতন ত্বরান্বিত হলো মোদি সরকার ক্ষমতায় আসার পর। প্রজাতন্ত্র সার্থক হয় তখনই যখন দায়িত্বপ্রাপ্ত সরকার সাংবিধানিক নৈতিকতা ও মূল্যবোধ কে কার্যকরী করে।
ভারত বর্ষ ক্রমশ ক্রমশ সহকারী প্রশাসনিক হস্তক্ষেপে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে মানুষের ব্যক্তি পরিষদ ও ব্যক্তিগত গোপনীয়তার ওপর আক্রমণ হচ্ছে।কে কি খাবে কে কার সঙ্গে ব্যক্তিগত জীবন আচরণ করবে এই সমস্ত ক্ষেত্রে প্রশাসনিক দানবের অনুপ্রবেশ ঘটেছে। অতিসম্প্রতি ব্যক্তিগত পরিসরে বিষয়ক মামলায়

সুপ্রিম কোর্ট স্পষ্ট করে বলেছেন- “A constitution has to be read in such a way that the words deliver by principal that had to be followed and if this is kept in mind it is clear that the concept of privacy is contained not merely in personal liberty but also in the dignity of the individual”।

এই ব্যক্তি মর্যাদা যা মৌলিক মানবাধিকার হিসেবে স্বীকৃত সেই মর্যাদা ২০১৪ উত্তর ভারতবর্ষে ব্যাপকভাবে লঙ্ঘিত হচ্ছে।যেকোনো রকম বিভিন্ন মতবাদ যা হিন্দুবাদের সাথে খাপ খায় না যেই মতামত আক্রান্ত হচ্ছে এবং ভিন্ন মতবাদী ওপর প্রশাসন এবং প্রশাসন সমর্থিত গুন্ডা বাহিনীর দ্বারা নির্যাতন নেমে আসছে।

সুপ্রিম কোর্ট এই প্রসঙ্গে মন্তব্য করেছেন – “democracy except difference of perception, acknowledges divergence in ways of life and accept decents”।

আজকে প্রজাতন্ত্র দিবসের মুখে দাঁড়িয়ে প্রতিটি নাগরিককে ভাবতে হচ্ছে তারা তাদের বিভিন্ন মত প্রকাশ করতে গিয়ে আক্রান্ত হবেন কিনা। বিশদ বিবরণ এর দরকার নেই সম্প্রতি কৃষক আন্দোলন এক চাঞ্চল্য তম উদাহরণ। এতদিন পর্যন্ত মানুষের আবেগকে তাড়িত করা হয়েছে যায় জাওয়ান জাই কিসান এই স্লোগান দিয়ে।যখনই বিভিন্ন স্তরের মানুষ তাদের সাংবিধানিক অধিকার রক্ষা নৈতিকতা রক্ষার দায়িত্বে লড়াই করেছেন তাদের সামনে এই শ্লোগান আওরে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করা হয়েছে তাদের। আর যখন সেই কৃষকরা নিজেদের রুটিরুজি নিয়ে বিক্ষোভরত এবং সেই বিক্ষোভ অবসরপ্রাপ্ত সেনাবাহিনী লোকেরাও যখন অংশগ্রহণ করেছেন কৃষক পরিবারের অংশীদার হিসেবে সেই আন্দোলনকে কালিমালিপ্ত করার জন্য একের পর এক অপবাদে তাদের ভূষিত করা হচ্ছে। আন্দোলনে যারা সহমর্মিতা দেখাচ্ছেন তাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন তদন্তকারী সংস্থা লেলিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এই সমস্ত করা হচ্ছে গণতন্ত্রকে ধুলিস্যাৎ করার জন্য।সুপ্রিম কোর্ট যখন স্পষ্ট ভাষায় বলছে গণতন্ত্রে বিভিন্ন মত চিন্তা গ্রহণ করা, তাকে সম্মান জানানো একান্ত জরুরী এবং প্রয়োজনে ভিন্ন ধরনের জীবনাচরণ এবং ভিন্ন মতামতকে শ্রদ্ধা প্রদান না করা সাংবিধানিক নৈতিকতাবিরোধী, গণতন্ত্রকে হত্যা করে।


স্বভাবতই প্রশ্ন আসে ভারতের সংবিধান কি বর্তমান শাসক দলের কাছে সুরক্ষিত? বহু সংগ্রামের ফলে অর্জিত এই সংবিধান লাঞ্ছিত হচ্ছে বর্তমান বিজেপি পরিচালিত সরকারের দ্বারা। প্রজাতন্ত্র দিবসের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আমাদের তাই অঙ্গীকার করতে হবে সাংবিধানিক মতাদর্শ, সাংবিধানিক মৌলিকতা ও গণতন্ত্রকে রক্ষা করতে হবে।সংবিধান ও গণতন্ত্র রক্ষা একটি রাজনৈতিক দায়িত্ব এই দায়িত্ব পালনে সমস্ত শুভবুদ্ধি সম্পন্ন গণতান্ত্রিক চেতনা সম্পন্ন মানুষ ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।

কবিগুরু


ভারতীয় গণতন্ত্র সংস্কৃতি ও মুক্ত জ্ঞানের রবীন্দ্র দর্শনকে দিয়ে লেখা শেষ করছি-

চিত্ত যেথা ভয়শূন্য, উচ্চ যেথা শির,
জ্ঞান যেথা মুক্ত, যেথা গৃহের প্রাচীর
আপন প্রাঙ্গণতলে দিবসশর্বরী
বসুধারে রাখে নাই খন্ড ক্ষুদ্র করি,
যেথা বাক্য হৃদয়ের উৎসমুখ হতে
উচ্ছ্বসিয়া উঠে, যেথা নির্বারিত স্রোতে
দেশে দেশে দিশে দিশে কর্মধারা ধায়
অজস্র সহস্রবিধ চরিতার্থতায়–
যেথা তুচ্ছ আচারের মরুবালুরাশি
বিচারের স্রোতঃপথ ফেলে নাই গ্রাসি,
পৌরুষেরে করে নি শতধা; নিত্য যেথা
তুমি সর্ব কর্ম চিন্তা আনন্দের নেতা–
নিজ হস্তে নির্দয় আঘাত করি, পিতঃ,
ভারতেরে সেই স্বর্গে করো জাগরিত।

বিশেষ সহযোগীতা – প্রতিপ দে (ছাত্র,স্নাতকোত্তর পলিটিক্যাল সায়েন্স, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়)

Spread the word