Populism

তৃণমূল কংগ্রেস: দক্ষিণ এশীয় পপুলিজমের একটি নির্দিষ্ট রূপ

সৌরভ গোস্বামী

‘প্রত্যেক যুগের শাসকশ্রেণির ধারণাগুলিই ওই যুগের শাসনকারী ধারণা হয়ে ওঠে।’ – কার্ল মার্কস

পপুলিজম প্রতিনিধিত্বের সংকট   

বিশ্বজুড়ে যখন পুঁজিবাদ তার নিওলিবারেল কাঠামোয় টিকে থাকার জন্য নানান কৌশল নিচ্ছে, তখন তারই একটি রাজনৈতিক অভিব্যক্তি হয়ে উঠেছে পপুলিজম—যেখানে জনগণের ‘আবেগ’ ও হতাশা রূপান্তরিত হয় শাসকের প্রতি নৈতিক আনুগত্যে।

এই পদ্ধতিতে ‘বিশুদ্ধ জনগণ’ ও ‘দুর্নীতিগ্রস্ত অভিজাত’—এই দুই মেরুর মধ্যকার এক সাংঘাতিক দ্বন্দ্বের মঞ্চ তৈরি হয়। কিন্তু বাস্তবে এই দ্বন্দ্ব শ্রেণি দ্বন্দ্ব নয়, বরং তার পরিবর্ত একটি  আলঙ্কারিক প্রতিস্থাপন বলা যেতে পারে। প্রথম বিশ্বে পপুলিজমের একাডেমিক চর্চা শুরু হলেও দক্ষিণ এশিয়ার প্রেক্ষিতে এই পপুলিজম এক বিশেষ রূপ পেয়েছে, যেখানে জাত, ধর্ম, অঞ্চল ও পরিচয়ভিত্তিক রাজনীতিকে ব্যবহার করে শাসকশ্রেণি তাদের আধিপত্য কায়েম রাখে।

আলোচ্য তৃণমূল কংগ্রেস ও তার নেতৃত্বাধীন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজনৈতিক কৌশলকে দক্ষিণ এশীয় পপুলিজমের একটি ‘সাবন্যাশনাল’ বা আঞ্চলিক রূপ হিসেবে বিচার করা হয়েছে। যুক্তি— তৃণমূলের শাসন এক ধরনের লুম্পেন বোনাপার্টবাদ, যেখানে তথাকথিত ‘নেত্রী’ আদতে পুঁজিবাদী কাঠামোকে একটি স্থানীয়, পৃষ্ঠপোষকতানির্ভর, দুর্নীতিপরায়ণ চেহারায় বজায় রাখেন।

দক্ষিণ এশীয় পপুলিজম: এক দমনমূলকগণআবেগ

দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে শ্রেণির বদলে ‘পরিচয়’ (Primordial Instinct) হয়ে উঠেছে সংগঠনের প্রধান ভিত্তি। পাকিস্তানে জুলফিকার আলি ভুট্টো “রুটি, কাপড়, মকান” শ্লোগান দিলেও বাস্তবে তিনি সামরিক-শিল্প গোষ্ঠীর আধিপত্যকে ভেঙে ফেলতে পারেননি। বরং সেই শাসনব্যবস্থাকে পুনর্গঠন করে তার ‘ক্যারিশমা’ ও ‘জাতীয়তাবাদ’-কে ব্যবহার করে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করেন।

বাংলাদেশে শেখ হাসিনা সরকার পরিকাঠামোগত উন্নয়নের নামে রাষ্ট্রকে নজরদারি, মিডিয়ার দমন, ও রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ নির্মূলের পথে চালিত করার অভিযোগ ওঠে গত বছরেই। মোদি সরকার হিন্দুত্ববাদকে ব্যবহার করে গরিব শ্রেণির মধ্যে জাতীয়তাবাদী বিভ্রম তৈরি করে, এবং কর্পোরেট পুঁজির সর্বগ্রাসী প্রভাব প্রতিষ্ঠা করেছে ভারতে।

এই তিনটি উদাহরণ থেকে বোঝা যায়—দক্ষিণ এশিয়ার পপুলিজম কোনও দিনই শ্রেণি-ক্ষমতায়নের পথ নয়। বরং তা এক ধরনের আধিপত্য রক্ষার রাজনৈতিক নাটক।

প্রগতিশীল রাজনীতির সংকট তৃণমূলের উত্থান

পশ্চিমবঙ্গে একসময় বামফ্রন্ট শ্রেণিভিত্তিক রাজনীতির বাস্তব মডেল স্থাপন করেছিল—ভূমিসংস্কার, পঞ্চায়েত, শ্রমিক সংগঠন ইত্যাদির মাধ্যমে। কিন্তু নব্বইয়ের দশক থেকে আমলাতান্ত্রিকতা ও টেকনোক্র্যাটিক বিচ্ছিন্নতা সিপিআই(এম)-এর জনভিত্তি দুর্বল করে দেয়।

এই শূন্যস্থান দখল করে তৃণমূল কংগ্রেস—যার প্রধান সম্পদ ছিল এক ‘টালির ঘরের সাধারণ মেয়ের’ নেতৃত্বের ক্যারিশমা, আবেগময় ভাষ্য, এবং সাংস্কৃতিক প্রতীক নিয়ে ক্ষমতার নতুন খেলা। ‘মা-মাটি-মানুষ’ হয়ে ওঠে এমন একটি ধোঁয়াশাপূর্ণ প্রতীকি ভাষ্য, যা শ্রেণি সংগ্রামকে প্রতিস্থাপন করে আবেগ ও পরিচয় রাজনীতির মাধ্যমে।

মমতা মডেল: আঞ্চলিক লুম্পেন পপুলিজম

তৃণমূল কংগ্রেসের রাজনীতিকে আমরা চারটি দিক দিয়ে বিচার করতে পারি:

১. কল্যাণকামীতার মুখোশে পৃষ্ঠপোষকতা:

সরাকারি সহায়তা প্রকল্পের মাধ্যমে নগদ টাকার মাধ্যমে রাজনৈতিক আনুগত্য দাবী করে। এর কোনটিই পরিকাঠামোগত পরিবর্তন আনেনি। কর্মসংস্থান, কৃষি ও শিল্পের সংকট অমীমাংসিত থেকে গেছে। Welfare’র নামে এমন পরিকল্পনা একধরনের দাতা-গ্রহীতার সম্পর্ক তৈরি করেছে— যেখানে নাগরিক অধিকার নয়, রাজনীতি নির্ধারণ করে একধরনের hostage politics।

২. আঞ্চলিক জাতীয়তাবাদ ও প্রতীকী সাংস্কৃতিকতাবাদ :

রবীন্দ্রনাথ, নেতাজি, দুর্গাপুজো ইত্যাদিকে ব্যবহার করে তৃণমূল ‘বাঙালিয়ানা’ রক্ষার দাবি তোলে। কিন্তু এর মধ্য দিয়ে শ্রেণি বৈষম্যের বাস্তবতা ঢাকা পড়ে যায়। এটি একটি সাংস্কৃতিক মোড়কে, নির্দিষ্ট রাজনৈতিক অর্থনৈতিক অভিসন্ধির আঞ্চলিক জাতীয়তাবাদ।

৩. প্রাতিষ্ঠানিক কেন্দ্রিকরণ ও দমননীতি:

বিশ্ববিদ্যালয়, পুরসভা, এমনকি স্থানীয় ক্লাব ও সংবাদমাধ্যম পর্যন্ত তৃণমূল নিয়ন্ত্রণ করে। দলীয় অনুগত্য ছাড়া সুযোগ নেই। বিরোধী কণ্ঠস্বর দমন হয় রাজনৈতিক হিংসা ও রাষ্ট্রীয় নজরদারির মাধ্যমে।

৪. লুম্পেন অর্থনীতি ও দুর্নীতির জাল:

‘কাটমানি’, শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতি, ত্রাণ চুরি, চক্রের মতো গড়ে ওঠা সিন্ডিকেট রাজ— এগুলি একধরণের নয়া ধনী শ্রেণি (লুম্পেন বুর্জোয়া) তৈরি করেছে। এরা ঐতিহ্যবাহী পুঁজিপতি নয়, বরং রাজনৈতিক আনুগত্য ও সরকারি সম্পদের লুঠের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা একধরনের পরজীবি শ্রেণি।

মার্কস ‘18th Brumaire’-এ যেমন বলেছিলেন, ‘The state becomes not the representative of any class, but the property of a parasitic lumpen-class, ruling in the name of the people.’ পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল মডেলও তাই— রাষ্ট্রশক্তি দলদাসে পরিণত হয়েছে।

জয় শ্রী রামবনামজয় বাংলা’: নির্বাচন নাট্যরাজনীতি

২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচন ছিল দুটি পপুলিস্ট ভাষ্যের সংঘর্ষ—বিজেপির ধর্মীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা বনাম তৃণমূলের আঞ্চলিক জাতীয়তাবাদ। এর ফলে গণতান্ত্রিক চর্চা পরিণত হয় নাটকে, যেখানে ভোটাররা হয়ে ওঠে “ভক্ত” বা “প্রাপক”।

বাম-কংগ্রেস-আইএসএফ ত্রিমুখী জোট ব্যর্থ হয়, কারণ তারা এই নাট্যভাষ্যের বাইরে গিয়ে বিকল্প দিতে পারেনি। শ্রেণির ভাষা হারিয়ে যায় পরিচয় ও আবেগের ছায়ায়।

পূর্ব বাম সমাজ বনাম বর্তমান তৃণমূল সমাজ: শ্রেণি বিন্যাসের রূপান্তর

বামফ্রন্ট আমলে যে ‘পার্টি-সোসাইটি’ গড়ে উঠেছিল, তা পুঁজিবাদের ভেতরেও একটি ন্যূনতম ন্যায়বিচার ও অংশগ্রহণের পরিসর দিয়েছিল। সেখানে জোতদার ও জমিদারদের বিরুদ্ধে গ্রামীণ পরিসরে এক প্রকার নিচুতলার প্রতিরোধ গড়ে উঠেছিল।

তৃণমূল আমলে সমাজটি রূপান্তরিত হয়েছে একধরনের লুম্পেন পুঁজি-নির্ভর সমাজে—যেখানে ঠিকাদার, সিন্ডিকেট, এবং স্থানীয় দুষ্কৃতীচক্র রাজনৈতিক ক্ষমতার প্রধান বাহক হয়ে উঠেছে। এরা ট্র‍্যাডিশনাল বুর্জোয়া নয়, বরং একধরনের ‘contractor-capitalism’-এর দালাল শ্রেণি।

বিপর্যয় নয়, সম্ভাবনার সময়

পশ্চিমবঙ্গের পপুলিজম একধরনের রাজনৈতিক নাটক— যা শাসকশ্রেণিকে এক ‘মুক্তিদাতা’(Lesser Evil) রূপে স্থাপন করে। এই নাট্যভাষ্য যতদিন থাকবে, ততদিন শ্রেণি-সংগ্রামের বাস্তবতা ঢেকে থাকবে।

তৃণমূল কংগ্রেস এই শাসনের এক ধরনের সংস্করণ— নগদ হস্তান্তর, প্রতীকী আবেগ, প্রতীকী উন্নয়ন, আর প্রতীকী সাংস্কৃতিক(!) প্রতিরোধের মধ্যে দিয়ে গরিব মানুষকে সরকারের (পড়ুন রাজনৈতিক দলের) প্রতি বশ্যতা স্বীকার করাতে বাধ্য করে।

বামপন্থার দায়িত্ব

শ্রেণি-রাজনীতির পুনরুদ্ধার।

বিকল্প সাংস্কৃতিক ও নৈতিক প্রতিবাদের জন্য একইসাথে সুগভীর ও সুবিস্তৃত আবহ গড়ে তোলা।

জনস্বার্থবাহী প্রতিষ্ঠানসমূহের উপযুক্ত পুনর্গঠন, যা নির্বাচনের বাইরেও টিকে থাকবে।

পপুলিজম বর্তমানে রাজনীতিকে দখল করেছে— কিন্তু ভবিষ্যৎ এখনও নির্মিত হচ্ছে। সে নির্মাণ হবেই, সংগঠনের মাধ্যমে, বিজ্ঞান সম্মত কল্পনার মাধ্যমে এবং অবশ্যই বিপ্লবী সাহসের মাধ্যমে।


শেয়ার করুন

উত্তর দিন