প্রাককথন
দর্শনকে রাজনীতি থেকে বিযুক্ত বিষয় হিসাবে প্রমাণ করার চেষ্টা আচমকা শুরু হয়নি। আরেকদিকে ধারাবাহিক চর্চার নাম করে প্রযুক্তিগত উৎকর্ষসাধনকেই ‘বিজ্ঞান’ বলে দেওয়ার অভ্যাসটিও আসলে রাজনীতি। তাই বিজ্ঞান, দর্শন ও রাজনীতির আন্তঃসম্পর্ক প্রসঙ্গে জরুরী কিছু আলোচনা বারংবার প্রয়োজন হয়। আজকের ভারতে এই তিনটি বিষয়ের সাথে ‘ইতিহাস ও তার বিকৃতি’ একই গুরুত্বে বিচার করার প্রয়োজন হয়ে পড়েছে। প্রাচীন ভারত ও তৎকালীন সমাজ সম্পর্কে অর্ধসত্য- অসত্য তথ্যকে সুচতুর কায়দায় সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়ার জঘন্য কৌশলটি এখন অনেকটাই বেআব্রু হয়ে গেলেও বিপদ এখনও রয়েছে। এই প্রসঙ্গেই রাজ্য ওয়েবডেস্কের তরফে ধারবাহিক প্রতিবেদন প্রকাশের পরিকল্পনা নেওয়া হয়।
জ্ঞানচর্চার বস্তুগত বাধ্যবাধকতা ও ঐতিহাসিক বিকাশকে কিভাবে বিচার বিশ্লেষণ করতে হয় তাকে সহজে, সকলের সামনে তুলে ধরাই আমাদের উদ্দেশ্য।
প্রতি সপ্তাহের বৃহস্পতিবার প্রকাশিত হবে।
মোট ছয় পর্বের আলোচনা।
আজ তারই প্রথম পর্ব।
শ্যামাশীষ ঘোষ
পর্ব ১
১৯৩২ সালে রবীন্দ্রনাথের পারস্য যাত্রায় বিমানভ্রমনের অভিজ্ঞতা প্রসঙ্গে তাঁর লেখা থেকে আলোচনা শুরু করা যেতে পারে।
“বায়ুতরী যতই উপরে উঠল ততই ধরণীর সঙ্গে আমাদের পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের যোগ সংকীর্ণ হয়ে একটামাত্র ইন্দ্রিয়ে এসে ঠেকল, দর্শন-ইন্দ্রিয়ে, তাও ঘনিষ্ঠভাবে নয়। নানা সাক্ষ্য মিলিয়ে যে পৃথিবীকে বিচিত্র ও নিশ্চিত করে জেনেছিলুম সে ক্রমে এলো ক্ষীণ হয়ে, যা ছিল তিন আয়তনের বাস্তব তা হয়ে এল দুই আয়তনের ছবি। সংহত দেশকালের বিশেষ বিশেষ কাঠামোর মধ্যেই সৃষ্টির বিশেষ বিশেষ রূপ। তার সীমানা যতই অনির্দিষ্ট হতে থাকে, সৃষ্টি ততই চলে বিলীনতার দিকে। সেই বিলয়ের ভূমিকায় দেখা গেল পৃথিবীকে, তার সত্তা হল অস্পষ্ট, মনের উপর তার অস্তিত্বের দাবি এল কমে। মনে হল, এমন অবস্থায় আকাশযানের থেকে মানুষ যখন শতধ্নী বর্ষণ করতে বেরোয় তখন সে নির্মমভাবে ভয়ংকর হয়ে উঠতে পারে, যাদের মারে তাদের অপরাধের হিসাববোধ উদ্যত বাহুকে দ্বিধাগ্রস্ত করে না, কেননা, হিসাবের অঙ্কটা অদৃশ্য হয়ে যায়। যে-বাস্তবের পরে মানুষের স্বাভাবিক মমতা, সে যখন ঝাপসা হয়ে আসে তখন মমতারও আধার যায় লুপ্ত হয়ে। গীতায় প্রচারিত তত্ত্বোপদেশও এই রকমের উড়ো জাহাজ – অর্জুনের কৃপাকাতর মনকে সে এমন দুরলোকে নিয়ে গেল, সেখান থেকে মারেই-বা কে, মরেই-বা কে, কেই-বা আপন, কেই-বা পর। বাস্তবকে আবৃত করবার এমন অনেক উড়োজাহাজ মানুষের অস্ত্রশালায় আছে, মানুষের সাম্রাজ্যনীতিতে, সমাজনীতিতে, ধর্মনীতিতে। সেখান থেকে যাদের উপর মার নামে তাদের সম্বন্ধে সান্তনাবাক্য এই যে, 'ন হন্যতে হন্যমানে শরীরে’।”
প্রাচীন ভারতের আলোচনা তৎকালীন সমাজ পরিবর্তনের ধারা ও এর সাথে জড়িত দার্শনিক মতগুলির আলোচনা নিয়ে। দার্শনিক মতের প্রধান দুই প্রতিপক্ষ বস্তুবাদী ও ভাববাদী দর্শন। রবীন্দ্রনাথের অসাধারণ অন্তর্দৃষ্টি দর্শনের এই দুই মূল ধারার সম্পর্কে আমাদের চোখ খোলার কাজটা করতে পারে। রবীন্দ্রনাথের সুদীর্ঘ জীবনের বিচিত্র পরিস্থিতিতে তাঁর চিন্তা-চেতনা প্রকাশিত হয়েছে নানা ভাবে। রবীন্দ্রনাথ কখনই অনড় বস্তুবাদী ছিলেন না, তবে এই কথাগুলি বস্তুবাদসম্মত। দর্শনের সঙ্গে রাজনীতির যে একটা সম্পর্ক আছে সেই প্রসঙ্গেই এই অন্তর্দৃষ্টির পরিচয় অতুলনীয়। মতাদর্শগত বা দার্শনিক কায়দায় মাটির পৃথিবী এবং তার রক্তমাংসে গড়া মানুষগুলির কথাও চেতনা থেকে মুছে ফেলা যায়। বিশুদ্ধ চেতনা ছাড়া তখন আর কিছু বাকি থাকে না। ওই বিশুদ্ধ চেতনাই তখন পরম সত্যের একমাত্র দাবিদার হয়ে দাঁড়ায়। দার্শনিকদের পরিভাষায়, একেই বলে চরম ভাববাদ। ‘ন হন্যতে হন্যমানে শরীরে’ – উদ্ধৃতিটার আড়ালে থাকা মুখোস খুলে দিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। মোদ্দা ব্যাপারটা – বস্তুবাদ বনাম ভাববাদ – বাঁচবার পথ আর মরবার পথ। এইটা মাথায় রেখেই এই আলোচনায় প্রবেশ করা যাক।
ভারতীয় দর্শনচিন্তার এই পটভূমির পরিপ্রেক্ষিতে আসা যাক এইরকম একটি বিষয় নিয়ে লেখার উদ্যোগ প্রসঙ্গে। মানব সভ্যতার বিবর্তনে পুরাণ ও ইতিহাসের মধ্যে বিভাজনরেখাটি খুব ক্ষীণ। পুরানগুলিকে খুব সহজেই ঐতিহাসিক তথ্য হিসাবে দাঁড় করানোর চেষ্টা হয়েছে বারবার, একটা জাতীয়তাবাদের ভিত্তি তৈরি করতে। পুরাণ কথা আসলে মানুষের সম্মিলিত ঐতিহাসিক স্মৃতি, এই ধারণা প্রসঙ্গে এরিক হবসবম বলেছেন: ‘এটা এমন নয় যে মানুষ প্রতিনিয়ত স্মরণ করে চলেছে, তারা স্মরণ করে কারণ কেউ তাদের প্রতিনিয়ত স্মরণ করায়’। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যেই মানুষের আবেগ জাগিয়ে তুলতেই এটি তাদের ক্রমাগত মনে করিয়ে দেওয়া হয়। এটি তখন অবধারিতভাবে বিবাদ ও সংঘাতের পরিস্থিতি তৈরি করে। সমাজের চেতনাকে করে তোলে প্রতিক্রিয়াশীল এবং পশ্চাদমুখী। সমাজের বৈচিত্র, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের বিকাশের পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়।
হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি এখন প্রাচীন ভারতের সবকিছুকে একটা ‘গৌরবময় অতীত’-এর তকমা পরিয়ে রাজনীতির মঞ্চে এনে ফেলছে – একটা উগ্র হিন্দু জাতীয়তাবাদী প্রকল্প। শিক্ষা জগতে এই ভাবনার অনুপ্রবেশ ঘটা শুরু হয়েছিল বেশ কিছুকাল আগেই। সেই প্রচেষ্টা চলছে একনিষ্ঠতার সাথে। জাতীয় শিক্ষানীতিতেও আমরা দেখতে পাচ্ছি ‘প্রাচীন এবং শাশ্বত জ্ঞান ও চিন্তার ঐতিহ্য’ ইত্যাদি শিক্ষানীতির লক্ষ্য হিসাবে ঘোষিত হয়েছে। বলা হচ্ছে, ‘ভারতীয় সংস্কৃতি এবং দর্শন বিশ্বের উপর একটি শক্তিশালী প্রভাব ফেলেছে। বিশ্ব ঐতিহ্যের এই সমৃদ্ধ উত্তরাধিকারগুলিকে শুধুমাত্র উত্তরসূরীদের জন্য লালন-পালন ও সংরক্ষণ করা নয় বরং আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার মাধ্যমে গবেষণা, প্রসারণ এবং নতুন ব্যবহারে লাগাতে হবে।’ বিদ্যাসাগর মশাই ১৮৫৩ সালেই লক্ষ করেছিলেন যে, ‘ভারতের পণ্ডিত সম্প্রদায়’-এর কাছে বৈজ্ঞানিক সত্যটা গৌণ, এমনকী অদরকারি; দরকারি হল সেই সত্যের সঙ্গে হিন্দুশাস্ত্রের কোনও ধারণার প্রকৃত অথবা কল্পিত মিলটা। সেই কারণে, সবকিছুর পর্দা সরিয়ে প্রাচীন ভারতে জ্ঞানচর্চার একটা বিজ্ঞানসম্মত অনুসন্ধান, আজকের সময়ে প্রয়োজন বলেই মনে হয়েছে।
প্রাচীন ভারতের – এবং সেই অর্থে, যেকোনও মহান প্রাচীন – সভ্যতার ভিতরে গর্ব করার মতো উপাদান অবশ্যই ছিল এবং সেগুলি উপেক্ষণীয় নয়। সেই প্রাচীন সময়ের মানুষের প্রকৃতিকে জানার প্রচেষ্টা, অনেক সংশয়, অজস্র প্রশ্ন, নানা অনুমান অবশ্যই এক আকর্ষণীয় পাঠ্য। প্রাচীন মানুষ প্রকৃতির মধ্যে থেকে তাঁদের জীবনযাপনের রসদ সংগ্রহ করার তাগিদে নানা কৌশল উদ্ভাবন করেছে, যা থেকে মধ্যযুগ হয়ে আধুনিক যুগের বিজ্ঞান অনেক রসদ সংগ্রহ করেছে, বিকশিত হয়েছে। সেই সময়ের দার্শনিক চিন্তাধারার মধ্যে আমরা বস্তুবাদী ভাবনার শিকড় দেখতে পাই, বিশেষ করে চিকিৎসা বিজ্ঞানে, চার্বাকদর্শনে। তবে, আধুনিক বিজ্ঞানের নানা আবিষ্কার সব প্রাচীনকালেই হয়েছিল বলে যে বাদ্য বাজানো চলছে, তা সম্ভব ছিল না সমাজের সেই বাস্তবতায়, সেটা পরিষ্কার হওয়া প্রয়োজন।
মেঘনাদ সাহা বলেছেন, ‘বিগত কুড়ি বৎসরে বেদ, উপনিষদ, পুরাণ ইত্যাদি সমস্ত হিন্দুশাস্ত্র গ্রন্থ এবং হিন্দু জ্যোতিষ ও অপরাপর বিজ্ঞান সম্বন্ধীয় প্রাচীন গ্রন্থাদি তন্ন তন্ন করিয়া খুঁজিয়া আমি কোথাও আবিষ্কার করিতে সক্ষম হই নাই যে, এই সমস্ত প্রাচীন গ্রন্থে বর্তমান বিজ্ঞানের মূলতত্ত্ব নিহিত আছে। সকল প্রাচীন সভ্যদেশের পণ্ডিতগণই বিশ্বজগতে পৃথিবীর স্থান, চন্দ্র, সূর্য, গ্রহাদির গতি, রসায়ন বিদ্যা, প্রাণী বিদ্যা ইত্যাদি সম্বন্ধে নানারূপ কথা বলিয়া গিয়াছেন, কিন্তু তা সত্ত্বেও বাস্তবিক পক্ষে বর্তমান বিজ্ঞান গত তিনশত বৎসরের মধ্যে ইউরোপীয় পণ্ডিতগণের সমবেত গবেষণা, বিচারশক্তি ও অধ্যবসায় প্রসূত। এ দেশে অনেকে মনে করেন, ভাস্করাচার্য একাদশ শতাব্দীতে অতি অস্পষ্টভাবে মাধ্যাকর্ষণ শক্তির উল্লেখ করিয়া গিয়াছেন সুতরাং তিনি নিউটনের সমতুল্য। অর্থাৎ নিউটন আর নূতন কি করিয়াছেন? কিন্তু এই সমস্ত ‘অল্পবিদ্যা ভয়ঙ্করী’ শ্রেণীর তার্কিকগণ ভুলিয়া যান যে, ভাস্করাচার্য কোথাও পৃথিবী অপরাপর গ্রহ, সূর্যের চতুর্দিকে বৃত্তাভাস (elliptical) পথে ভ্রমণ করিতেছে, এ কথা বলেন নাই। তিনি কোথাও প্রমাণ করেন নাই যে, মাধ্যাকর্ষণ শক্তি ও গতিবিদ্যার নিয়ম প্রয়োগ করিলে পৃথিবীর ও অপরাপর গ্রহের ভ্রমণকক্ষ নিরূপণ করা যায়। সুতরাং, ভাস্করাচার্য বা কোন হিন্দু, গ্রীক বা আরবী কেপলার-গ্যালিলিও বা নিউটনের বহুপূর্বেই মাধ্যাকর্ষণতত্ত্ব আবিষ্কার করিয়াছেন, এরূপ উক্তি করা পাগলের প্রলাপ বই আর কিছুই নহে। দুঃখের বিষয় দেশে এইরূপ অপবিজ্ঞান প্রচারকের অভাব নাই, তাঁহারা সত্যের নামে নির্জলা মিথ্যার প্রচার করিতেছেন মাত্র’। মেঘনাদ সাহা বৈজ্ঞানিকের নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে বুঝেছেন যে, প্রাচীন ধর্মগ্রন্থসমূহ যে সমস্ত জাগতিক তথ্য, ঐতিহাসিক জ্ঞান ও মানবচরিত্রের অভিজ্ঞতার উপর প্রতিষ্ঠিত, তার উপর দাঁড়িয়ে বর্তমান যুগের উপযোগী চেতনা প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না। বৈজ্ঞানিক মনোবৃত্তির ভিত্তিতে নবযুগের উপযোগী ‘আধ্যাত্মিকতা’র প্রতিষ্ঠা করার প্রচেষ্টা দরকার।
ভারতে বিজ্ঞান-চেতনার অবক্ষয় নিয়ে আলোচনায় আধুনিক বিদ্বানদের মধ্যে প্রথমেই আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়ের নাম উল্লেখযোগ্য। প্রফুল্লচন্দ্রের রচনায় যা নজর করার মত, তা হল প্রকৃতিবিজ্ঞানে তাঁর অন্তর্দৃষ্টি। ভারতে প্রকৃতিবিজ্ঞান অনেক প্রতিশ্রুতি নিয়ে শুরু হলেও কালক্রমে তার অবক্ষয় হয়েছিল। একটা পর্যায় পর্যন্ত পৌঁছে এদেশে প্রকৃতিবিজ্ঞানের চর্চা অবরুদ্ধ হয়ে গিয়েছিল। কিসের বাধায় বিজ্ঞানের অগ্রগতি অবরুদ্ধ হয়েছিল কিংবা, বিজ্ঞান-চেতনার অবক্ষয়ের আসল কারণ কী, সেই বিষয়েও তাঁর মতামত প্রণিধানযোগ্য।
প্রফুল্লচন্দ্র এদেশে বিজ্ঞানচেতনার অবক্ষয়ের ব্যাখ্যা হিসাবে সামাজিক এবং মতাদর্শগত কারণের উল্লেখ করেছেন। সামাজিক কারণ ছিল সমাজে বর্ণাশ্রম ব্যবস্থা – বা জাতিভেদ প্রথা। এর ফলে হাতের কাজ ও মাথার কাজের মধ্যে গড়ে উঠেছিল গভীর খাদ। যাঁরা হাতের কাজ করেন, কায়িক শ্রমের মাধ্যমে প্রকৃতির সঙ্গে যাঁদের সবচেয়ে নিবিড় সংযোগ, সমাজে তাঁদের নেহাতই নীচু জাতের মানুষ হিসাবে দেখা হল। অথচ, প্রকৃতির অন্তর্নিহিত রহস্য আবিষ্কার করবার কলাকৌশল তাঁদেরই আয়ত্তে। শিক্ষার সুযোগ থেকে বঞ্চিত বলেই তাঁদের অভিজ্ঞতাটা মুখে-মুখে এবং অনুকরণ মাধ্যমে শুধুমাত্র কলাকৌশল হিসাবে বংশপরম্পরায় চলে আসতে লাগল। শিক্ষিত সমাজের বিদ্যাবুদ্ধির বা পুঁথিপত্রের আঙিনায় তাঁর প্রবেশ অধিকার ছিল না। বিদ্বান-সমাজ থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন বলেই তাঁদের অভিজ্ঞতা বিদগ্ধদের বিদ্যাবুদ্ধির ক্ষেত্রে কোনো পুষ্টি যোগাতে পারেনি। তারই ফলে বিদগ্ধ সমাজের একচেটিয়া ধ্যানধারণা ক্রমশই শীর্ণকায় ও প্রাণশক্তিবিহীন হয়ে পড়ে। বিজ্ঞান বলতে যদি প্রকৃতিকে জানার – এবং সেই জ্ঞানের ভিত্তিতে আয়ত্তে আনবার – প্রয়াসই হয়, তাহলে বর্ণাশ্রম সমাজে তার অপমৃত্যু অনিবার্য। আচার্য প্রফুল্লচন্দ্রের মতে, প্রাচীন যুরোপীয় ইতিহাসের ক্ষেত্রেও মূলত একই ব্যাপার। প্রাচীন গ্রীস ও রোম-এ দাসপ্রথার শিকড় যতোই দৃঢ় হয়েছে ততোই ক্ষীণপ্রাণ হয়েছে বিজ্ঞান চেতনা।
ভারতে বিজ্ঞান-চেতনার অবক্ষয়ের দ্বিতীয় কারণ হিসেবে প্রফুল্লচন্দ্র মতাদর্শের প্রসঙ্গ তুলেছেন; তাঁকে দর্শনের আঙিনায় প্রবেশ করতে হয়েছে। তারই ভিত্তিতে তিনি অনুভব করেন, আমাদের সাবেক-কালের দর্শনের মধ্যে কোনটি বিজ্ঞান চেতনার বা বিজ্ঞানবিকাশের পথরোধ করতে চেয়েছে। এই আলোচনায় প্রবিষ্ট হয়ে তিনি ভারতীয় বিজ্ঞান চেতনার অবক্ষয়ের জন্য যে দার্শনিক মতকে – বা দেশে যে-মতের প্রবল প্রতাপকে – বিশেষ করে দায়ী করেছেন তা শঙ্করাচার্য প্রচারিত মায়াবাদ। শঙ্কর পরিদৃশ্যমান তামাম জগতকে বললেন আসলে মায়া বা মিথ্যা। এই ভাবনায় বিশ্বপ্রকৃতির নিয়মকানুন গভীরভাবে জানবার – এবং সেই জ্ঞানের ভিত্তিকে আয়ত্তে এনে মানুষের সুখসমৃদ্ধি বাড়াবার – সমস্ত চেষ্টাই একরকম মিথ্যা হয়ে যায়। সোজা কথায় বিজ্ঞান বলে ব্যাপারটাই একরকম অর্থহীন হয়ে পড়ে।
প্রফুল্লচন্দ্রের ভাষায়, ‘শঙ্কর দ্বারা সংশোধিত ও ব্যাখ্যা করা বেদান্ত দর্শন, যা বস্তুজগতের অবাস্তবতা শিক্ষা দেয়, ভৌত বিজ্ঞানের অধ্যয়নকে বদনাম করার জন্যও অনেকাংশে দায়ী’। পরমাণুবাদের বিরুদ্ধে শঙ্করের জেহাদটা তাই তাঁর কাছে প্রতিবিজ্ঞানের – বা বিজ্ঞানবিরোধিতার – এক প্রকৃষ্ট নিদর্শন। শঙ্করের মতে যুক্তির স্বীয় গুরুত্ব বা প্রতিষ্ঠা নেই; নেহাত শাস্ত্রমত সমর্থন করবার উদ্দেশ্যে যুক্তির যেটুকু প্রয়োগ, শুধুমাত্র সেটুকু পর্যন্তই তার মূল্য। স্বাধীন যুক্তির – শাস্ত্র-নিরপেক্ষ যুক্তির – একেবারে কোনো মূল্যই নেই। কারণ চরম প্রমাণ বলতে শাস্ত্রবাক্য এবং শাস্ত্র-অনুগামীদের উক্তি। শাস্ত্র-অনুগামী বলতে অবশ্যই মনু প্রভৃতি শাস্ত্রকারের অনুগামী। পরমাণুবাদের বিরুদ্ধে শঙ্করের আসল আপত্তি, পরমাণুবাদ শাস্ত্রবিরুদ্ধ এবং শাস্ত্রানুগামী মনু প্রভৃতি স্মৃতিকারদেরও বক্তব্য-বিরুদ্ধ – তাই বিষের মতো পরিত্যাজ্য। ইউরোপের ইতিহাসেও মধাযুগে মোটের উপর একইভাবে শাস্ত্রবচনের দোহাই দেখিয়ে বিজ্ঞানের বিকাশ অবরোধ করার আয়োজন ছিলো।
প্রফুল্লচন্দ্র তাই মন্তব্য করছেন, 'যে মানুষজন জাতি/ বর্ণ ভেদে পরিবেষ্টিত এবং কর্তৃপক্ষ এবং বেদ, পুরাণ ও স্মৃতির আদেশ দ্বারা আড়ালে-আবদ্ধ, এবং তাদের বুদ্ধি এইভাবে সংকীর্ণ ও পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে পড়ে, তাদের মধ্যে কোনও বয়েল উঠে আসতে পারে না, এমন যুক্তিসংগত নীতি নির্ধারণ করার জন্য ...’। প্রত্যক্ষ-পরীক্ষানির্ভর প্রকৃতিবিজ্ঞানের পথই মানবমুক্তির আসল পথ। বিজ্ঞান ও দর্শন নিয়ে, কিংবা, বিজ্ঞানের মতাদর্শগত ভিত্তি নিয়ে আলোচনায়, প্রফুল্লচন্দ্রের মতে, বিজ্ঞানচেতনার সহায় হওয়া তো দূরের কথা, ভারতীয় ইতিহাসে মায়াবাদই প্রকৃতিবিজ্ঞানের বিকাশে বিশেষ বাধা সৃষ্টি করেছিলো।
প্রধানত দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়, হেমন্ত গঙ্গোপাধ্যায়, সুকুমারী ভট্টাচার্য প্রমুখ – এঁদের প্রাসঙ্গিক গবেষণামূলক লেখাগুলি ভারতের প্রাচীন সময়ে বেদ এবং অবৈদিক সূত্রগুলি থেকে সেই সময়কার মানুষের বস্তুবাদী এবং ভাববাদী দর্শনের সূত্রপাত, ভাববাদী দর্শনের প্রতি মানুষের সংশয়, বিজ্ঞান চেতনার অঙ্কুরোদ্গমের বিষয়গুলি বিস্তারে আলোচনা করেছে। এগুলি সেই সময়কে কিছুটা বুঝতে সাহায্য করে আমাদের। এই লেখাটি কোনো মৌলিক গবেষণার ফল নয়। উল্লিখিত রচনাগুলি থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে একটি যুক্তিনির্ভর, সহজবোধ্য আলোচনা করাই উদ্দেশ্য।
ঋণ স্বীকার:
১) সুকুমারী ভট্টাচার্য – প্রাচীন ভারত সমাজ ও সাহিত্য
২) সুকুমারী ভট্টাচার্য – বেদে সংশয় ও নাস্তিক্য
৩) দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় – ভারতে বস্তুবাদ প্রসঙ্গে
৪) দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় – লোকায়ত দর্শন
৫) Debiprasad Chattopadhyay – Science and Philosophy in Ancient India
৬) Debiprasad Chattopadhyay – History of Science and Technology in Ancient India – The Beginnings
৭) হেমন্ত গঙ্গোপাধ্যায় – চার্বাক দর্শন