সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে নারীর লড়াই এবং সুফিয়া কামাল

গৌতম রায়

বিশ শতকে বাঙালি নারীর সামাজিক উত্তরণের ক্ষেত্রে সুফিয়া কামাল এক ঐতিহাসিক নাম। হিন্দু-  মুসলমান নির্বিশেষে নারী সমাজ যাতে নিজের পায়ের তলায় জমি খুঁজে পান, তার জন্য সুফিয়া কামাল তাঁর গোটা জীবন ব্যয় করেছেন। তিনি নিজে যে সামাজিক সংকটের ভেতর দিয়ে নিজের জীবন শুরু করেছিলেন , সেই সামাজিক সংকট থেকে কি করে নিজের প্রজন্ম এবং পরবর্তী প্রজন্মকে উত্তরিত করতে পারা যায়-- সেটাই ছিল সুফিয়া কামালের জীবনের লড়াইয়ের সবথেকে বড় লড়াই।

এইরকম  পর্যায়ক্রমের ভেতর দিয়ে তাঁর পূর্বসূরী বেগম রোকেয়া বা তারও আগে যাঁরা নারী সমাজের জন্য ভাবনা চিন্তা করেছিলেন, যেমন; রামমোহন, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, মীর মোসারফ  হোসেন বা বিগত শতকের দুইয়ের দশকে ,'মুসলিম সাহিত্য সমাজ',  'শিখা গোষ্ঠী' র মুক্ত-বুদ্ধির পান্থজনেরা,  সমসাময়িক কালে ব্রাহ্ম আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত মানুষজনেরা ,তাঁরা সবাই নিজেদের মতন করে তাঁদের লড়াই টাকে জারি রেখেছিলেন। সেই ধারার লড়াইকে আরো অগ্রবর্তী  করবার ক্ষেত্রে সুফিয়া কামালের যে সংগ্রাম ,সেই সংগ্রামের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল '৪৭ এর  দেশভাগের পরবর্তী সময়ে,  তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালির সংকটের বিভিন্ন পর্যায়গুলি ।

এই পর্যায়ের সংকট সংগ্রাম কিন্তু রামমোহন, বিদ্যাসাগর, মীর মোশারফ হোসেন, ফয়জুন্নেছা, রোকেয়া বা ব্রাহ্ম আন্দোলনের সমাজকর্মী, তাঁদের কাউকেই অতিক্রম করতে হয়নি। এমনকি এপার বাংলায় ,পশ্চিমবঙ্গে যাঁরা নারী মুক্তির জন্য লড়াই করেছেন, বিশেষ করে ,প্রগতিশীল ভাবধারার সঙ্গে সম্পৃক্ত থেকেছেন, বামপন্থী আন্দোলনে গণজাগরণের ভেতর থেকে নারী মুক্তির জন্য লড়াই করেছেন ,নারী-পুরুষ নির্বিশেষে তাঁদের কাউকেই নতুন করে সাম্রাজ্যবাদের হানাদারি ,যেটা সুফিয়া কামালকে অতিক্রম করতে হয়েছিল তেমনটা করতে হয়নি।

এই দিক থেকে বিচার করলে বলতে হয় '৪৭ এর দেশভাগের পরবর্তী পর্যায়ে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের প্রত্যক্ষ মদতে দেশ ভাগে হিন্দু-মুসলিম উভয় সাম্প্রদায়িক শক্তির যে মূলধন ছিল সাম্প্রদায়িকতা ,সেই সাম্প্রদায়িকতাকে চিরস্থায়ী করে ,কেবল ভারতীয় উপমহাদেশে নয় ,গোটা দক্ষিণ এশিয়া জুড়ে একটা অস্থিরতা বজায় রেখে, সাম্রাজ্যবাদের নতুন পর্যায়ের আগ্রাসনকে সফল করবার লক্ষ্যে, পশ্চিম পাকিস্তানকে বোরের চাল হিসেবে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের যে ব্যবহার  তার বিরুদ্ধে মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করে ,একদিকে সামাজিক লড়াই, অপরদিকে ধর্মকে অস্বীকার না করেও ধর্মান্ধতার এবং ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহারের বিরুদ্ধে নারীকে সংগঠিত করে, নারীর অর্থনৈতিক স্বাবলম্বনের জন্য লড়াইয়ের নেতৃত্ব দেওয়া --এই জায়গা থেকে সুফিয়া কামাল পূর্ব পাকিস্তান পর্বে বা পরবর্তীকালে মুক্তিযুদ্ধের কালে এবং মুক্তিযুদ্ধ উত্তর কালে ,আবার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সপরিবারে শাহাদাত বরণের পর ,এই যে বিভিন্ন পর্যায়ে গুলি থেকে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছেন ,ভারতীয় উপমহাদেশে নারীর সার্বিক স্বাধীনতার জন্য, সার্বিক অধিকারের জন্য, এমন লড়াই করা ব্যক্তিত্ব আমরা খুব বেশি খুঁজে পাই না ।

নারীর অধিকারের প্রশ্নে সুফিয়া কামালের চিরদিনের লড়াই ছিল কিন্তু নারীর জন্য একটি সম্পূর্ণ আকাশ তৈরি। কিন্তু সেই সম্পূর্ণ আকাশের জন্য তিনি পুরুষের সঙ্গে কোনো রকম অনৈতিক ,অশুভ প্রতিদ্বন্দ্বিতায় যেতে রাজি ছিলেন না। তিনি চেয়েছিলেন;  নারীর সমান অধিকার।  নারীর বেশি অধিকার-এমন কল্পিত ,সার্বিক ভারসাম্যহীন, কোনো সমাজব্যবস্থার কল্পনা কখনোই কিন্তু সুফিয়া কামাল করেননি।

পাকিস্তান সৃষ্টির পর তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের হিন্দু- মুসলমান নির্বিশেষে নারীর স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার প্রশ্নে, বিশেষ করে নারীর অর্থনৈতিক স্বাবলম্বনতা অর্জনের প্রশ্নে, সুফিয়া কামাল যে লড়াই করেছিলেন, তার তুলনা ভারতীয় উপমহাদেশ তো কোন ছাড় ,গোটা বিশ্বে খুব একটা দেখতে পাওয়া যায় না। মুসলিম জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে '৪৭ এর দেশভাগ প্রথম অবস্থায় আর্থ - সামাজিক উন্নয়নের প্রশ্নে বাঙালি মুসলমানের একাংশের ভেতরে যে আশা-আকাঙ্ক্ষার একটা প্রদীপ জ্বালিয়েছিল, খুব তাড়াতাড়ি সেই আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রদীপটি নিভে যায়। পশ্চিম পাকিস্তান এবং সেখানকার নেতৃবৃন্দ কেবলমাত্র যে বাঙালি মুসলমানকে ব্যবহার করেছিল পাকিস্থান হাশিলের জন্যে, বাঙালি মুসলমানের আর্থ-সামাজিক উন্নতির দিকে তাদের যে বিন্দুমাত্র ভাবনা-চিন্তা ছিল না ,সেটা জিন্না সাহেবের জীবিতাবস্থাতেই তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের মানুষদের একটা বড় অংশের মধ্যে ক্রমশ পরিষ্কার হতে শুরু করে ।

যাঁরা পশ্চিম পাকিস্তানের মুসলিম জাতীয়তাবাদী ভাবনাচিন্তার ধারক-বাহক ,তাঁদের সেই রাজনৈতিক অভিপ্রায় এবং পূর্ব পাকিস্তানের মানুষদের প্রতি তাঁদের অর্থনৈতিক শোষণকামী মানসিকতা বুঝতে সক্ষম হয়েছিলেন ,রাজনীতিতে হোসেন শাহিদ সোহরাওয়ার্দী এবং তাঁর তরুণ সহকর্মী হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের সাথে সাথেই সামাজিক ক্ষেত্রে সুফিয়া কামালের নামটিকে বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে উল্লেখ করা দরকার।

পূর্ব পাকিস্তান সৃষ্টির পর দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি ঘিরে নারীকে কিভাবে ঘরের ভেতরে হেঁশেলে লড়াই করতে হচ্ছে, সেটা অনুভব করে, নারীর সেই লড়াইটিকে ময়দানে নামিয়ে আনার ক্ষেত্রে, সদ্য প্রতিষ্ঠিত পূর্ব পাকিস্তানেই শুধু নয় ,দুই পাকিস্তান মিলিয়েই প্রথম আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন কিন্তু সুফিয়া কামাল। কোনো রাজনৈতিক নেতৃত্ব তখনো পর্যন্ত কিন্তু দ্রব্যমূল্য ধীরে বৃদ্ধি ঘিরে যে সামাজিক সমস্যা ধীরে ধীরে প্রকট হয়ে উঠছে, তা নিয়ে সেভাবে ভাবনা চিন্তা করেননি অথচ এই বিষয়টি যে রাজনৈতিক আন্দোলনের ক্ষেত্রে কেবল নয়, গোটা সামাজিক প্রেক্ষিত কে ,বিশেষ করে নারীকে  অর্থনৈতিক ভাবে অবরুদ্ধ করে রাখবার ভাবনাকে ,কিভাবে পুরুষ শাসিত সমাজ , কখনো রাজনীতির দোহাই দিয়ে ,কখনো অর্থনীতির দোহাই দিয়ে, আবার কখনো ধর্মের দোহাই দিয়ে আরও অবরুদ্ধ করে ,একেবারে উনিশ- বিশ  শতকের আঙ্গিকে নারীকে পিছিয়ে দিতে চায়-- সেটা উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন সুফিয়া কামাল।

এই উপলব্ধি থেকেই তিনি অবিভক্ত পাকিস্তানের প্রথম দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির  বিরুদ্ধে আন্দোলনে নারী সমাজকে নিয়ে ঢাকার রাজপথে আন্দোলনের  নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। প্রথাগত কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সুফিয়া কামালের কোনোদিন ন্যূনতম সম্পর্ক ছিল না , কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষের মানসিকতাকে বাঙালি জনজীবনে প্রতিষ্ঠিত করবার তাগিদে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের মতই পাকিস্তান সৃষ্টির অব্যবহিত পরের সময় থেকেই মুসলিম জাতীয়তার কবরে পেরেক ঠুকে বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিজয় বৈজয়ন্তী  ওড়ানোর ক্ষেত্রে সুফিয়া কামাল ,তাঁর সহকর্মীদের নিয়ে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছিলেন।

যে মুসলিম জাতীয়তাবাদকে ভিত্তি করে, গোটা মুসলমান সমাজকে ভুল বুঝিয়ে ,ধর্মের ভিত্তিতে দেশ ভাগ করেছিল হিন্দু এবং মুসলমান সম্প্রদায়িক মৌলবাদী নেতারা, সেই মানসিকতার সঙ্গে সুফিয়া কামাল কোনোদিন নিজেকে মেলাতে পারেননি। তা বলে অবিভক্ত বাংলায় ,কলকাতা কেন্দ্রিক রাজনীতিতে হিন্দু বাঙালি অভিজাতদের আধিপত্যে, তদানীন্তন পূর্ববঙ্গে মুসলমান সমাজের ,বিশেষ করে গ্রামীণ মুসলমান সমাজের মানুষ যাঁরা অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে রয়েছেন, তাঁদের শিক্ষা, সংস্কৃতি, চাকরি -বাকরি থেকে শুরু করে অর্থনৈতিক স্বাবলম্বনতা ,সমস্ত প্রশ্নেই যে হিন্দু অভিজাত রাজনীতির আধিপত্য জনিত সংকট, সেই সংকট ঘিরে সুফিয়া কামালের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল কিন্তু অত্যন্ত স্বচ্ছ। সেই স্বচ্ছতাকে কিন্তু কোনো অবস্থাতেই দেশভাগের পক্ষে সাম্প্রদায়িক মানসিকতা প্রসূত স্বচ্ছতা বলা যায় না ।

দীর্ঘদিন ধরে অভিজাত হিন্দু সমাজ রাজনীতিকে কুক্ষিগত করে, পূর্ববঙ্গে যেহেতু মুসলমান মানুষ জনের সংখ্যাধিক্য , সেই কারণে পূর্ববঙ্গের মুসলমানদের সমস্ত রকম ভাবে অবদমিত করে রাখার চেষ্টা করেছিল। পশ্চিম পাকিস্থান দেশভাগের পরে কলকাতাকেন্দ্রিক হিন্দু অভিজাত, উচ্চবর্ণের রাজনীতির ধারাটিই পূরাব পাকিস্থানে হিন্দু- মুসলমান নির্বিশেষে বাঙালির উপরে প্রয়োগ করতে শুরু করে। সেই অবদমনের বিরুদ্ধে জাগ্রত বিবেক উন্মেষের ক্ষেত্রে একুশের মহান ভাষা আন্দোলনের সময় কালে ,ভাষা কে ভিত্তি করে বাঙালিকে বিভাজিত করবার পশ্চিম পাকিস্তানের মানসিকতার বিরুদ্ধে সংগ্রামে র সুতীর্ণ বিবেক হয়ে উঠেছিলেন সুফিয়া কামাল।

ভাষা আন্দোলনের পর তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের প্রায় সব অঞ্চলেই যেভাবে ধীরে ধীরে পশ্চিম পাকিস্তানের নয়া সাম্রাজ্যবাদী মানসিকতা কায়েম হতে শুরু করে ,সেই মানসিকতার বিরুদ্ধে  সাধারণ মানুষকে সামাজিক সচেতন করবার জন্য সুফিয়ার যে ভূমিকা, সেই ভূমিকা পরবর্তীকালে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা প্রসারণের ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের কাছে অত্যন্ত সহায়ক হয়ে উঠেছিল।

'৪৭ এর বিভাগ উত্তর সময়কালে সাম্রাজ্যবাদের যে নতুন ষড়যন্ত্র  সেই ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে নারী সমাজকে সঙ্ঘবদ্ধ করায় কেবল নয়, নারী সমাজের ভেতর দিয়ে পুরুষ সমাজের কাছেও সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সঙ্ঘবদ্ধ হওয়ার আহ্বান সুফিয়া কামালের --এই ঐতিহাসিক অবদান গোটা ভারতীয় উপমহাদেশে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ উত্তর কালে রাজনৈতিক সামাজিক এবং অর্থনৈতিক ইতিহাসের ক্ষেত্রে নিঃসন্দেহে এক নতুন অধ্যায় তৈরি করেছে।

*মতামত লেখকের ব্যক্তিগত


শেয়ার করুন