সৌভিক ঘোষ
ঝড় শুরু হলে আঁধার নামে, চেনা পথ আবছা হয়ে আসে।
ঝড় এলে ভেঙ্গে পড়ে জরাজীর্ণ সৌধ যত যা কিছুও- যা কিছু ভেঙ্গে পড়াই উচিত।
প্রকৃতি আর যাই হোক ইনভেস্টমেন্ট ব্যংক নয় বলেই ঝড়ের অভিঘাত একমুখী হয় না, ভেঙ্গে পড়ার মধ্যেই মাথা তোলে সেইসবও- মাথা তোলার মতো শক্তি যারা ইতিমধ্যেই অর্জন করেছে।
১৯৩৬ সাল। প্রগতি লেখক শিল্পী সংঘ।
১৯৪২-এ ইন্ডিয়ান পিপলস থিয়েটার অ্যাসসিয়েশন- আই পি টি এ'র সূচনা।
ঘোষণায় লেখা হল-
‘The fact is, as Caudwell points out, that poets have suffered from the illusion of freewill, “the bourgeois illusion.” They have sought freedom by pitting their individual wills against society and have necessarily failed, for real freedom can only be won by cooperation with society. The apparent freedom of the artist and the intellectual is in fact subservience to the dominant interests in society-interests which require that attention should be diverted from the real content of the life of our time, which is social struggle, the attainment and maintenance of freedom, peace and progress.. This accounts for the fact that much of recent art provide a pleasurable feeling of being highly advanced and yet by inducing a vague, pessimistic helplessness effectively short-circuit any impulse to action.
For how long, to come down to brass tacks, for how long shall we be able to enjoy art for its own sake without worrying about politics and economics? And if only the few elect are the guardians of our culture, will not they be bludgeoned into uneasy submission to the forces of evil, as has happened under fascism to the world's best educated nation? How long can the writer revel in a revised form of the old romantic bohemianism, how long can he retain his hot-house “freedom” which is another name for selfishness and social irresponsibility? How much longer will he take to realise that the saving of his art is in the People, with whose consciousness he must re-establish his kinship?’
এই ধারা বেয়েই আমাদের দেশে ফিল্ম সোসাইটি মুভমেন্টের সুত্রপাত।
ততদিনে বোম্বে’তে হিন্দি সিনেমার অনেকটাই পুঁজির দখলে চলে গেছে। তাই আঞ্চলিক ভাষায় নির্মিত হওয়া শুরু হল সমান্তরাল সিনেমা। ছায়াছবি- যা শুধু মোহগ্রস্থ করে না, তুলে ধরে যা চলছে সেই সত্যকে। বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে নির্মিত ঝুটা স্বপ্নের ফেরিওয়ালাদের একেবারে বিপরীতে পথ চলা- যা সত্য তা যতই অপছন্দের হোক না কেন, সেটাই হবে বিষয়। এই পথে এগিয়ে এলেন এক ঝাঁক নতুন চিত্রপরিচালক। মৃণাল সেন তাদেরই অন্যতম একজন ছিলেন।
সত্যজিত রায় যা করেছেন তাকে ক্ষয়িষ্ণু সামাজিক মূল্যবোধের পুনর্নির্মাণ বলতে হয়- তার নির্মাণে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রভাব তাই সবচাইতে বেশি। শার্প কাট, ডেডিকেটেড জার্ক ও উদ্বাস্তু জীবন যন্ত্রণার অভিঘাতে বুর্জোয়া পেলবতাকে তছনছ করে দিলেন ঋত্বিক ঘটক। দেশভাগের প্রেক্ষাপটে তার লেখা সংলাপ ‘আই অ্যাকিউজ’ আসলে মানবতাকেই কাঠগড়ায় তোলে, যদিও সেই প্রশ্নের সামনে বুদ্ধিজীবী সমাজ মুখচোরা সাজে বলেই- ‘কারে?... কাউকে না!’ অবধি এসে শেষ করতে কার্যত বাধ্য হলেন। মৃণাল সেনের সিনেমা এই দুই ধারার থেকেই স্বতন্ত্র।
তিনি মার্কসবাদী একথা কখনও গোপন করতে চাননি। সিনেমা নির্মাণ করতে গিয়েই তিনি সিনেমার ভাষা খুঁজেছেন। নিজেকে দাঁড় করিয়েছেন প্রবাহের কিনারায়, সম্মুখের খাদ কতদুর ভয় দেখাতে পারে সেই উপলব্ধিকে বাচ্যে তুলে এনেছেন। তাই তার লেন্সে ঘরের নোনা দেওয়াল কোনও নস্টালজিয়া বা কোনও বিনির্মানের উদ্দেশ্যে নয়, ব্যবহৃত হয়েছে সুনির্দিষ্ট প্রেক্ষিতের ক্যানভাস হয়ে। জীবনযাপনের গোদা মানের ক্রমাবনমণ ঘটছে, তার ধাক্কায় মানুষ একটু একটু করে তলিয়ে যাচ্ছে একদিন না, প্রতিদিন এবং এমন অবস্থার জন্য পুঁজিবাদই দায়ী- সোজাসুজি সেই কথাটাই ‘দেখিয়ে’ দেন তিনি। তার সিনেমায় ব্যবহৃত সংলাপ কিছুটা সরল, বক্তব্যের ধার বাড়াতেই হয়ত। সাহিত্য যদি ইতিহাসের আয়না হয় তবে চলচ্চিত্রও সমসাময়িক ঘটনাপ্রবাহের ‘লুকিং গ্লাস’ হতে পারে, এমন ভাবনাই তার নির্মাণের ভিত হিসাবে কার্যকরী থেকেছে। ‘শিল্পের জন্যই শিল্প’ বলে যে নির্লজ্জ ভাবনা বাণিজ্যিক স্বার্থের সুরক্ষা যোগায় তার বিরুদ্ধে এহেন অবস্থানের জন্যই মৃণাল সেন’কে সেই যুদ্ধের কম্যান্ডার বলা চলে। বিশ্বচলচ্চিত্রে অসামান্য অবদানের জন্য ১৯৭৯ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন তাকে পুরস্কৃত করে। ৮১ সালে ভারত সরকারের দ্বারা পদ্মভূষণ, ৮৫ সালে ফরাসী রাষ্ট্রপতির তরফে ‘Commander of the Order of Arts and Letters’ অবধি পর্যায়ে সেই কম্যান্ডারকেই আমরা খুঁজে পাই।
১৯৫৫ সালে তার পরিচালনায় প্রথম চলচ্চিত্র মুক্তি পায়- রাত ভোর। ২০০২ সালে শেষ কাজ- আমার ভুবন। সেই জার্নির মাঝেই ১৯৬৯ সালে নির্মিত ভুবন সোম সিনেমার জন্য জাতীয় পুরষ্কার।
একাধিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাম্মানিক ডি লিট সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সবার শেষে- ২০০৯ সালে। ছ-বছর আগেই, ২০০৩ সালে দাদা সাহেব ফালকে পুরষ্কার। এই মানুষটিই নিজের স্মৃতিচারনায় উল্লেখ করেছেন জুরি হিসাবে কাজ করতে গিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে দ্বিধাগ্রস্থ হয়ে পড়লে শেষ অবধি তাকে মেনে নিতে হয় পুরষ্কার সেই সিনেমারই পাওয়া উচিত যেটি শিল্পের, সৃষ্টির মাপকাঠিতে উৎকৃষ্ট, কোন দেশের সিনেমা বা কে তার নির্মাতা এসবই গৌণ। শেষ অবধি বস্তুবাদী দর্শনে আস্থাশীল ছিলেন বলেই নিজস্ব দ্বিধাকে আড়াল করেননি। অনেক বাঁক মোড় রয়েছে তার নির্মাণে, মানুষের অস্তিত্বে বহু পরস্পর বিরোধী বোধের সমাহারকে পর্যবেক্ষণ করেছেন বলেই। দ্বিধা, দ্বন্দ্ব, নীচতা সবই রয়েছে- তবু মানুষই সভ্যতার নির্মাতা, সমস্ত পাশবিক প্রবৃত্তির নাগপাশ কেটে বেরিয়ে নতুন যুগের আগুন বুকে ধরতে মানুষই পারে। বিখ্যাত পরিচালক কখনো আকাশ থেকে নেমে আসেন না, তারাও এই পৃথিবীর জল-হাওয়াতেই বড় হয়ে ওঠেন। সেই পরিচালক অবলীলায় রাস্তার মাঝে এঁকে রাখা ডিভাইডারে শুয়ে পড়লে সেই ছবি আমাদের চেতনায় শিল্পীর সহজাত বিচ্ছিন্নতাকে অননুকরণীয় যোগ্যতার আঁচ দিতে চাইলেও আসলে ঐ কাজ একনিষ্ঠ নির্মাণের জন্য নিবেদিত মেধার নিবিড় মুহূর্ত ছাড়া আর কিছুই নয়। মৃণাল সেন রাস্তায় শুয়ে পড়েছিলেন- রাস্তা খুঁজে পেতে চেয়েছিলেন বলেই। শুধুমাত্র সিনেমার নির্মাণ সেই পথের শেষ লক্ষ্য নয়।
একলা পদাতিক শুধু নিজেকে এগিয়ে নিয়ে চলবে নাকি গোটা সমাজকে সামনে এগিয়ে যেতে পিছন থেকে ধাক্কাও দেবে? এই অনুভব আমাদের যে দর্শনের সামনে টেনে ফেলে সেটাই প্রগতি প্রসঙ্গে মার্কসবাদ- আর কিছুই নয়।
আজ সেই মানুষের জন্মশতবর্ষের সুচনা।