একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্তিম পর্বে মিত্রশক্তির কাছে পাক হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণের পঞ্চাশ বছর পূর্তিতে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের সন্তানদের সংগঠন ' প্রজন্ম ৭১' দীর্ঘদিন ধরে যে প্রশ্নটিকে সামনে মেলে ধরছে,' তোমাদের যা বলার ছিলো ,বলছে কি তা বাংলাদেশ ' -- এই প্রশ্নটিই যেন আরো বেশি প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে। পশ্চিম পাকিস্তানের সাম্রাজ্যবাদী মানসিকতার বিরুদ্ধে , জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি সমাজ , বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে যে ঐতিহাসিক লড়াই লড়ে ছিল , সেই লড়াইয়ের মূল ভিত্তি হিসেবে সাম্রাজ্যবাদবিরোধীতা ,গণতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি র সঙ্গে ধর্মনিরপেক্ষতার একটা বিশেষ ভূমিকা ছিল। গত ১০০ বছরে বিশ্বে র রাজনৈতিক আন্দোলন বিশ্লেষণের প্রেক্ষিত প্রথম তিনটি আন্দোলন, যা কোন অবস্থাতেই সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ পরিপূর্ণ ছিল না, এমন একটি তালিকা তৈরি করলে, প্রথমেই থাকে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের নাম।

মুক্তিযুদ্ধে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির মনোভাব ভাঙতে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের সহায়তায় পাক হানাদাররা বহু চেষ্টা করেছে। কিন্তু তাদের সে চেষ্টা কোন অবস্থাতেই সফল হয়নি। বাংলাদেশের মানুষ শেষ দিন পর্যন্ত কোনরকম প্ররোচনায় ফাঁদে পা না দিয়ে , মুক্তিযুদ্ধের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্রটিকে প্রাণ দিয়ে রক্ষা করেছে। তাই মহান মুক্তিযুদ্ধের সুবর্ণ জয়ন্তি বর্ষের প্রেক্ষিতে, বিজয় দিবস এবার কেবল বাংলাদেশেই নয়, গোটা ভারতীয় উপমহাদেশ, তথা দক্ষিণ এশিয়ার মানুষদের কাছে নিজেকে মেলে ধরছে একটা ভিন্ন মাত্রা নিয়ে। গোটা বিশ্বই যখন সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের আকীর্ণ, গণতন্ত্রের সংকটে দীর্ণ এবং সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদের আঘাতে ছিন্নভিন্ন, এইরকম একটি সময়ে, সম্পূর্ণ ধর্মনিরপেক্ষতার উপর ভিত্তি করে , মহান মুক্তিযুদ্ধের সশস্ত্র লড়াই , নিঃসন্দেহে একটি ঐতিহাসিক প্রেরণা উপস্থাপিত করে।
মহান মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লক্ষ শহিদের রক্তের বিনিময়ে, বহু সহস্য নারীর লাঞ্ছনার বিনিময়ে, বহু আত্মত্যাগ , রক্ত শ্বেদ, কান্নার বিনিময়ে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের সৃষ্টি। 'মুসলিম জাতীয়তা' র উপর ভিত্তি করে দেশভাগের অল্প কিছুদিনের মাথাতেই , মুক্তিযুদ্ধের মত একটি সশস্ত্র সংগ্রামের ভেতর দিয়ে দেশের স্বাধীনতা অর্জনের পর ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নেতৃত্বে বাংলাদেশ ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধান গ্রহণ করেছিল। তা ছিল মহান মুক্তিযুদ্ধের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্রের প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপন।
সেই ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধানকে বাংলাদেশ রক্ষা করতে পারেনি। রক্ষা করতে না পারার একটি বড় কারণ হল ,বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা। এই কুখ্যাত হত্যাকাণ্ডের পর, স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ, কার্যত পাকিস্তানের একটি ছায়া উপনিবেশে পরিণত হয়েছিল। কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমের নাগরিকত্ব কেড়ে নিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু র সরকার যুদ্ধাপরাধের নিরিখে ।সপরিবারে বঙ্গবন্ধুর শাহাদাত বরনের অব্যবহিত পরে রাজাকার পুনর্বাসনকারী জিয়াউর রহমান দেশের বাইরে গা ঢাকা দিয়ে থাকা, কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমকে দেশে ফিরে আসার অনুমতি দেয়। জিয়া পত্নী খালেদা জিয়ার প্রধানমন্ত্রীত্ব কালে, বিচার ব্যবস্থাকে কুক্ষিগত করে , বাংলাদেশের সংখ্যাগুরু মৌলবাদী শক্তি, আদালতকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করেই, কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমের নাগরিকত্ব ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হয়।

১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুর শাহাদাৎ বরণ থেকে শুরু করে ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনার প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করবার সময় পর্যন্ত গোটা বাংলাদেশে , সেখানকার রাষ্ট্রশক্তি, ধর্মনিরপেক্ষতা আর সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বিষয়টিকে কার্যত একটি নিষিদ্ধ বিষয়ে পরিণত করেছিল। অবিভক্ত পাকিস্তানে পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকেরা নিজেদের অকর্মণ্যতার ঢাকতে যেভাবে ইসলামীকরণ কে একমাত্র ঢাল হিসেবে ব্যবহার করেছিল সেই পথেই , বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর, অবৈধ উপায়ে ক্ষমতা দখলকারী জিয়াউর রহমান এইচ এম এরশাদ ব্যবহার করতে শুরু করে। আজ বিজয় দিবসের সুবর্ণজয়ন্তীতে আমাদের সবথেকে বেশি যন্ত্রণাবিদ্ধ অভিজ্ঞতা হল ; একাত্তরের ঘাতক-দালাল যুদ্ধাপরাধীদের জিয়াউর রহমান এরশাদ এবং খালেদা জিয়া র শাসনকালে সামাজিক, রাজনৈতিক, সংস্কৃতিক পূনর্বাসনের বিষয়টি। রাজাকার পুর্নবাসনের ভেতর দিয়ে এই সব ব্যক্তিরা , মহান মুক্তিযুদ্ধের যে মূল চেতনা ,সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতা এবং ধর্মনিরপেক্ষতা, সেইসাথে গণতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি, প্রত্যেকটি চেতনাকেই ক্ষতবিক্ষত করতে শুরু করে। গণতন্ত্র অবলুপ্ত হয় বাংলাদেশ থেকে। ধর্মনিরপেক্ষতা তো হয় ই ।আর সাম্রাজ্যবাদবিরোধী একটি শব্দ উচ্চারিত হয় না বাংলাদেশের প্রশাসনের পক্ষ থেকে।
এই অবস্থায় সবথেকে স্মরণীয় হলো সেদেশের মুক্তবুদ্ধির বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা। লেখক-শিল্পীদের ভূমিকা। আবুল ফজলের মতো বুদ্ধিজীবী যিনি গত শতকের চারের দশকে বাংলা দ্বিতীয় জাগরণ নামে অভিহিত' মুসলিম সাহিত্য সমাজ' ও' শিখা' গোষ্ঠীর সক্রিয় একজন সভ্য ছিলেন , তিনিও ধীরে ধীরে মৌলবাদী দৃষ্টিভঙ্গির দ্বারা আচ্ছন্ন হয়ে পড়তে শুরু করলেন। জিয়াউর রহমানের কাছে মুক্তবুদ্ধির মানুষজন রা হয়ে উঠলেন সব থেকে বড় শত্রু।
আজ ভারতে যেভাবে এখানকার রাষ্ট্রশক্তি, মুক্তবুদ্ধি সম্পন্ন, বিজ্ঞানমনস্ক, ধর্মনিরপেক্ষ বুদ্ধিজীবী সমাজ কে সব থেকে বড় শত্রু বলে মনে করে , তেমনটাই সেদিন বাংলাদেশের শাসকেরাও মনে করেছিল। তাই আজকের ভারতে যেমন অন্নদাশঙ্কর রায় জীবিত থাকলে, তাঁকে হত্যা করতে পিছপা হতো না রাজনৈতিক হিন্দু সাম্প্রদায়িক মৌলবাদী শিবির। কারণ, কালবুর্গি থেকে গোবিন্দ পানসারে, গৌরী লঙ্কেশ, প্রত্যেকটি ক্ষেত্রেই ভারতের সংখ্যাগুরু সাম্প্রদায়িক শক্তি, অর্থাৎ; হিন্দু সম্প্রদায়িকেরা , হত্যা ,ষড়যন্ত্রের পথ অবলম্বন করেছে। উপমহাদেশে ফ্যাসিবাদের চরণধ্বনি হিসেবে। সাম্প্রতিক অতীতে সেই পথ নির্মাণের প্রথম প্রয়াস দেখতে পাওয়া যায় বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধু হত্যার পর । মুক্ত বুদ্ধির চিন্তা-চেতনার বিরোধী রাষ্ট্রনায়ক জিয়াউর রহমান, এইচএম এরশাদ খালেদা জিয়ার ভেতরে পাক হানাদারদের বুদ্ধিজীবি হত্যার আদলেই মানসিকতা কাজ করতো।

যুদ্ধপরাধীদের সামাজিক পুনর্বাসনের বিরুদ্ধে বঙ্গজননী সুফিয়া কামাল ,শামসুর রাহমান, কলিম শরাফী, কবীর চৌধুরী, বদরুদ্দীন উমর, আহমেদ শরীফ, নির্মলেন্দু গুণ, মহাদেব সাহা, সানজিদা খাতুন ,সুলতানা কামাল, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, অনুপম সেন, দেবেশ চন্দ্র ভট্টাচার্য , সৈয়দ হাসান ইমাম প্রমুখের যে লড়াই ,সেই লড়াই ছিল কিন্তু জিয়াউর রহমান থেকে, খালেদা জিয়া, এইসব শাসকদের কাছে সব থেকে ।
ছয়ের দশকে আইয়ুব খান যেভাবে বাঙালিকে বিভক্ত করে, তার ফৌজি শাসনকে চিরস্থায়ী করতে সচেষ্ট ছিলেন, ঠিক সেই পথেই বাঙালিকে বিভক্ত করে, হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে বিভাজন তৈরী করে ,পাকিস্তান যাতে আবার বাংলাদেশ কে নিজেদের করায়ত্ত করে নিতে পারে সব রকম ভাবে, তার জন্য সচেষ্ট ছিল জিয়াউর রহমান, এরশাদ ,খালেদা জিয়া। মূল উদ্দেশ্য ছিল পাকিস্তানের যে তাদের মূল মস্তিষ্ক, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ,তাকে সব রকম ভাবে সাহায্য করা। বাংলাদেশের যুবসমাজ যেতে কোন অবস্থাতে রাজনীতি মুখি না হয়, শাসকের অপকৌশল সম্বন্ধে সচেতন না হয় ,তার জন্য বাংলাদেশে একটা সমান্তরাল অর্থনীতি এইসব শাসকেরা চালিয়েছিল মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী মদদপুষ্ট বিভিন্ন ধরনের সেবা নিয়ে বসে থাকা এনজিওদের মাধ্যমে।
কার্যত এইসব এনজিওরা বঙ্গবন্ধুর শাহাদাত বরণের সময় কাল থেকে শেখ হাসিনার প্রথম দফার প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সময়কাল পর্যন্ত, গোটা বাংলাদেশে একটা সমান্তরাল প্রশাসন চালিয়ে গেছে সে দেশের শাসকদের প্রত্যক্ষ মদতে শাসকদের স্বার্থ পূরণের উদ্দেশ্যে। বলাবাহুল্য ,শাসকের স্বার্থ পূরণের এইসব উদ্দেশ্যের পেছনে কিন্তু লুকিয়ে ছিল তাদের মূল মস্তিষ্ক মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের স্বার্থ রক্ষা করা।
সোভিয়েত ইউনিয়ন যখন জাজ্জ্বল্যমান ছিল, তখন গোটা দক্ষিণ এশিয়ায় নিজেদের শাসন কায়েম করবার সবথেকে বড় তাগিদেই, মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ, পাকিস্তানের মতো তাঁবেদার কে ব্যবহার করে ,বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে যারা পাকিস্তান ক্রীড়নক, পাকবাহিনীর সেবাদাস হিসেবে আত্মনিবেদিত ছিল, তাদের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে হত্যা করে , বাংলাদেশের মাধ্যমে ,গোটা দক্ষিণ এশিয়াতে, নিজেদের আধিপত্য বিস্তারের প্রাথমিক পদক্ষেপ অত্যন্ত জোরদারভাবে শুরু করেছিল।
এরশাদের আমল পর্যন্ত এই পদক্ষেপ ছিল অত্যন্ত তীব্র। আর সোভিয়েত ইউনিয়নের ভেঙে যাওয়ার সময় কালের প্রায় সমান্তরাল সময়ে স্বৈরাচারী এরশাদ বিরোধী গণ আন্দোলনের জেরে, এরশাদের ক্ষমতা ত্যাগ, এই ঘটনাকে নিছক কাকতালীয় বলে, আমরা এড়িয়ে যেতে পারি না। কারণ, স্বৈরাচারী এরশাদের পরিবর্তে তখন খালেদা জিয়ার মতো একটি পুতুলকে রাষ্ট্রক্ষমতায় বসিয়ে , তাকে নিয়ন্ত্রণের মূল সুতোটি ইসলামাবাদের হাতে রাখার যে পথ, সেই পথেই মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ হেঁটেছিল।
কারণ, স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের জেরে এরশাদের পদত্যাগের পর যে তত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল বাংলাদেশের বিচারপতি শাহাবুদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে, সেই সরকার কি খালেদা জিয়াকে ক্ষমতায় প্রতিষ্ঠিত করতে কোন রকম সাহায্য করেছে ?

এই প্রশ্নটিই এই কারণে তীব্র হয়ে ওঠে যে, শেখ হাসিনার প্রথম দফার প্রধানমন্ত্রীত্বের অবসানে , জাতীয় সংসদের নির্বাচনের ঠিক মুখে এই শাহাবুদ্দিন আহমেদ তৎকালীন নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে প্রবল ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়ে, শেখ হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করে , নির্বাচনকে কার্যত প্রহসনে পরিণত করে। এই কাজে অবশ্যই ভারতের তৎকালীন বিজেপি সরকার , বাংলাদেশের সমস্ত রকমের সংখ্যাগুরু মৌলবাদী এবং পাকিস্তানপন্থি শক্তিকে সাহায্য করেছিল। হিন্দু মৌলবাদ এবং মুসলিম মৌলবাদ উভয়েই , শ্রেণীরস্বার্থের তাগিদে নিজেদের অভিন্নতা হেতু ,যে যখন বিপদে পড়েছে ,অপর সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদ , সেই বিপদ্গ্রস্থকে সাহায্য করতে সব রকম ভাবে আত্মনিয়োগ করেছে।
এটা কেবল বাংলাদেশের ক্ষেত্রে বা ভারতের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। গোটা বিশ্বের ক্ষেত্রে কিন্তু উভয়ের মৌলবাদের মধ্যে এই শ্রেনীস্বার্থ জনিত সখ্যতা এবং পারস্পরিক বোঝাপড়া আছে। ইউরোপে খ্রিস্টান মৌলবাদ আর মুসলিম মৌলবাদের মধ্যে পারস্পরিক বোঝাপড়া , সহযোগিতার লক্ষণ খুব তীব্র ভাবে দেখতে পাওয়া যায়। তাই বাংলাদেশে মুসলিম মৌলবাদকে পুনরায় প্রতিষ্ঠা করে, ভারতের হিন্দু মৌলবাদী শক্তি নিজেদের লাভের অংক বুঝে নিতে চাইছিল। কারণ, বাংলাদেশে ,সেখানকার সংখ্যাগুরু মৌলবাদের দাপটে যদি সে দেশের সংখ্যালঘু হিন্দুরা নির্যাতিত হয়, তাহলে ভারতের সংখ্যাগুরু হিন্দু মৌলবাদীরা, বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতনের বিষয়টির অবতারণা করে , ভারতের সংখ্যালঘু মুসলমানদের ওপর ভয়াবহ অত্যাচার চালাতে পারবে।
এই পাটিগণিত কে অবলম্বন করেই ২০০১ সালের বাংলাদেশের জাতীয় সংসদের নির্বাচনে ত্রিপিটক ষড়যন্ত্রে শেখ হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সপরিবারে শহীদ হওয়ার পর থেকেই , বাংলাদেশে যে গণতন্ত্রের সংকটই আবির্ভূত হয়, সেই সংকট গোটা দেশটিকেই ,মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে মুছে ফেলে, পাকিস্তানি ঔপনিবেশিকতার যে ছায়া, তাকে তীব্র করে তুলতে শুরু করে।
এই পর্যায়ে রাজাকার-আলবদর-আলশামস সহ গোটা যুদ্ধাপরাধীদের যে ভূমিকা তৎকালীন শাসকদের প্রত্যক্ষ মদতে ধীরে ধীরে বাংলাদেশের উপর প্রকট হয়ে উঠতে শুরু করে, তাকে কিন্তু বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবী সমাজ এক কথায় মেনে নেয়নি। রাজনৈতিক আন্দোলনের পাশে, সামাজিক আন্দোলন কে একটা উচ্চমাত্রায় উপনীত করে বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবী সমাজ ,ধীরে ধীরে রাজাকার-আলবদর-আলশামস সহ যাবতীয় যুদ্ধাপরাধী এবং ঘাতক দালালদের বিরুদ্ধে সাধারণ মানুষদের সঙ্গবদ্ধ করতে শুরু করেন। শাসকেরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ভুলিয়ে দেওয়ার জন্য আপ্রাণ প্রচেষ্টা চালায় ।পাঠ্যসূচিতে মুক্তিযুদ্ধকে কার্যত অবলুপ্ত করে দেওয়া হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের অবদান কে ঢেকে দিয়ে জিয়াউর রহমানকে 'স্বাধীনতার ঘোষক '(!) হিসেবে উপস্থাপিত করে একটা বিকৃত চেতনা বাংলাদেশের মানুষদের মধ্যে চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চালায় জিয়াউর রহমানেরা।
স্বৈরাচারী এরশাদের বিরুদ্ধে গণআন্দোলন, সেই আন্দোলন সংগঠিত করবার ক্ষেত্রেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিষয়টিকে অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে সেই সময়ে বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতৃত্ব তুলে ধরতে শুরু করেছিলেন। তাঁরা এই কাজটি শুরু করতে পেরেছিলেন সেদেশের মুক্তবুদ্ধির বুদ্ধিজীবীদের সহায়তায়। পরবর্তীকালে খালেদা জিয়া যখন প্রধানমন্ত্রী , মুক্তিযুদ্ধের সময়কালীন বরিশালের শান্তি কমিটির প্রধান আবদুর রহমান বিশ্বাস কে সে দেশের রাষ্ট্রপতি করে। জামায়াতে ইসলামীর অন্যতম শীর্ষ নেতা মতিউর রহমান নিজামীকে সেদেশে কৃষিমন্ত্রী করে ।তা ছাড়াও আরো বহু যুদ্ধাপরাধীকে ,ঘাতক দালাল কে নানানভাবে সামাজিক পুনর্বাসন দেয়। সেই সময় থেকেই এই ঘাতক-দালালদের বিচারের দাবিতে বাংলাদেশ একটা নতুন পর্যায়ের সামাজিক আন্দোলন, রাজনৈতিক আন্দোলন কে অত্যন্ত শক্তিশালী করে তোলে। আন্দোলন সংঘটিত হতে শুরু করে।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে সংগঠিত এই আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন শহিদ জননী জাহানারা ইমাম। নেতৃত্তের ভার জনগণ বঙ্গজননী কবি সুফিয়া কামালের উপর অর্পণ করতে চাইলেও , সুফিয়া কামাল বলেন; আমি আন্দোলনের সঙ্গে সর্বাত্মকভাবে আছি। কিন্তু আন্দোলনের নেতৃত্ব দিক জাহানারা।
একাত্তরের ঘাতক-দালালদের বিচারের দাবিতে সংগঠিত ঘাতক দালাল নির্মূল ও একাত্তরের চেতনা বাস্তবায়ন সমন্বয় কমিটি গোটা বাংলাদেশের কার্যত মুক্তিযুদ্ধের একটি দ্বিতীয় পর্যায়ে সৃষ্টি করেন। বিরানব্বই সালের ২৬ শে মার্চ কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমের বিচারের দাবিতে, নুরেমবার্গের গণআদালতের আদলে ঢাকার সোহরাওয়ার্দী ময়দানে ঐতিহাসিক গণআদালত সংঘটিত হয়।
তার আগে যুদ্ধাপরাধীদের অপরাধের অনুসন্ধানের উদ্দেশ্যে তৈরি হয়েছিল গণতদন্ত কমিশন। এই সমস্ত কাজেই সুফিয়া কামাল ,কবীর চৌধুরী, আহমেদ শরীফ ,শামসুর রহমান , পান্না কায়সার ,শমী কায়সার, সৈয়দ হাসান ইমাম, অনুপম সেন, দেবেশ ভট্টাচার্য, কলিম শরাফী প্রমূখ মুক্তবুদ্ধির বুদ্ধিজীবীরা ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছিলেন।
খালেদা জিয়ার সরকার বাংলাদেশের এইসব সোনার সন্তানদের বিরুদ্ধে দেশদ্রোহিতার মামলা পর্যন্ত এনেছিল । দেশদ্রোহিতা সেই মামলা মাথায় নিয়েই শহিদ জননী জাহানারা ইমামের জীবনাবসান হয়। নির্মূল কমিটির এই গণআন্দোলন কার্যত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে পুনঃস্থাপিত করবার ক্ষেত্রে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করে। সাম্প্রদায়িকতার পথ থেকে বাংলাদেশকে ধর্মনিরপেক্ষতায় উপস্থাপিত করতে, হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে সম্প্রতি পুনঃস্থাপিত করতে, বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীরা ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছিলেন। এমন ভূমিকা সাম্প্রতিক অতীতে কোন দেশে ,কোন বুদ্ধিজীবীদের ভেতরে দেখতে পাওয়া যায়নি।

আজ শেখ হাসিনা সে দেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নে যে ধরনের পদক্ষেপ নিতে সক্ষম হন, বিশেষ করে সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা প্রদানের ক্ষেত্রে যে আন্তরিকতার পরিচয় দেন, তার ভিত্তিভূমি কে বাস্তবের উপর নির্মাণ করার ক্ষেত্রে তাঁর পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের যেমন ঐতিহাসিক ভূমিকা আছে ,তেমনি আছে সুফিয়া কামাল, শামসুর রাহমান প্রমুখ মুক্তবুদ্ধির পান্থজনের প্রভাব।
আজকের বাংলাদেশকে বিনষ্ট করতে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে উৎপাটন করতে, সে দেশের ভেতরে একটা শক্তি অত্যন্ত সক্রিয়। মূলত পাকিস্তানের মদতে বাংলাদেশের সংখ্যাগুরু মৌলবাদীরা গোটা দেশটা কে ধর্মান্ধতার মোড়কে আবৃত করে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে ধ্বংস করে দিতে সচেষ্ট। এই তৎপরতার পিছনে শেখ হাসিনার সরকারকে উৎখাত করার ষড়যন্ত্র টি ও অত্যন্ত প্রবল। কারণ, মৌলবাদীদের কাছে শেখ হাসিনা বা তাঁর সরকারের ধর্ম নিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি হচ্ছে সবথেকে আপত্তির কারণ।
তাই এত প্রতিবন্ধকতার ভেতরেও , একদিকে ধর্মনিরপেক্ষতার বিজয় বৈজয়ন্তীটি কে বজায় রাখা অপরদিকে পদ্মা সেতুর বাস্তবায়ন সহ আধুনিক পথে বাংলাদেশকে প্রতিষ্ঠিত করা, এই উন্নয়নমূলক কর্মসূচি, এইসবের ভেতর দিয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধের সুবর্ণজয়ন্তী, বিজয় দিবসের সুবর্ণজয়ন্তী,মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে আজকে নতুনভাবে বাংলাদেশের মানুষের কাছে তুলে ধরছে।
লেখায়ঃ গৌতম রায়