The Meghnad Roars: A Retrospect

ওয়েবডেস্ক প্রতিবেদন

বাঙালি মননের ‘মেঘনাদ’

১৮৬১। বাঙালির কৃষ্টির ইতিহাসে সম্ভবত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বছর। কারণ, এই বছরেই জন্ম হয়েছিল সেই মানুষটির যিনি বাঙালির চিন্তা ও মননকে নতুনভাবে প্রভাবিত করেছিলেন – রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। কিন্তু আত্মবিসস্মৃত জাতি ভুলেই গিয়েছে, ঠিক সেই বছরেই একসঙ্গে চারটি কাব্য লিখেছিলেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত। মধু কবির প্রতি নাক-সিঁটকানো বাঙালির সংখ্যা নেহাত কম নয়। তার পিছনে রয়েছে একাধিক কারণ – বিধর্মী, মদ্যপ, লম্পট – বিশেষণের অন্ত নেই মাইকেলকে নিয়ে। কিন্তু মাইকেল মধুসূদন দত্তকে কি শুধু সেইটুকু পরিসরে ধরা সম্ভব?

যে বছরে চারটি কাব্য একসঙ্গে লিখেছিলেন সেই ১৮৬১-এর কথাই ধরা যাক। এই চারটি কাব্যের মধ্যে একটি ছিল ‘মেঘনাদবধ’। নিন্দুকেরা বলতেই পারেন, “ও তো মিল্টনের ‘প্যারাডাইস লস্ট’ থেকে নেওয়া।“ ভুল এখানেই। স্রেফ ‘নেওয়া’ নয়, ‘অনুকরণ’ নয়, বরং ওই ধাঁচে ফেলে আপামর ভারতবাসীর আরাধ্য দেবতার দিকে বজ্রনির্ঘোষে আঙুল তোলা; প্রশ্ন তোলা দৈবশক্তির মোনোপলি নেওয়া চরিত্রের হাতে দেবকূলের চোখের বালি হয়ে ওঠা আর এক চরিত্রের।কিন্তু হঠাৎ কেন এমন পৌরাণিক কাহিনিতে নিজেকে খুঁজতে চাইলেন মাইকেল? নেহাতই কাব্যসৃষ্টি করবেন বলে? একেবারেই নয়। বরং তার নেপথ্যে রয়েছে অনেক গভীর কারণ। যেখানে পৌরাণিক পরিমণ্ডল বা পরিসরকে রূপকের মতো ব্যবহার করেছিলেন মাইকেল।

রাজা রামমোহন রায়ের সময় থেকে শুরু করে যে অধ্যায়কে বাংলার নবজাগরণ বা রেনেসাঁ বলে অভিহিত করা হয়, জনমানসে তার প্রকৃত প্রভাব ছিল কতটুকু? রামমোহন সতীদাহ প্রথা বন্ধ করার ক্ষেত্রে অবশ্যই অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিলেন। কিন্তু সেই ‘বেঁচে যাওয়া’ বিধবারা সত্যিই কীভাবে বেঁচে থাকবেন তার দিশা দেখাতে পারেননি। রামমোহনের সেই অসম্পূর্ণ কাজকে শেষ করার দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। মেয়েদের স্কুল তৈরি করা থেকে বিধবাবিবাহ – সাধ্যমতো সমস্ত কাজ করতে গিয়ে কার্যত কপর্দকশূন্য হয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু সত্যিই কতটা প্রভাব ফেলেছিল সেই পরিবর্তন? তথ্য অনুযায়ী, বিদ্যাসাগরের টাকায় ৩৯ জন বিধবার বিবাহ দেওয়া সম্ভব হয়েছিল এবং সব ক্ষেত্রেই বিপুল অঙ্কের পণ দিতে হয়েছিল বিদ্যাসাগরকে। অর্থাৎ, ‘নবজাগরণ’ শব্দবন্ধ প্রয়োগ করে বাঙালি যতই আত্মপ্রসাদ লাভ করুক না কেন, আদতে তা ঘুণধরা সমাজব্যবস্থায় বিশেষ ছাপ ফেলতে পারেনি।

ঠিক এই পরিস্থিতিতেই মাইকেলের কলম থেকে বেরিয়েছিল ‘মেঘনাদবধ’। যেখানে পৌরাণিক সমাজব্যবস্থার সঙ্গে তথাকথিত আধুনিক সমাজের কোনও বুনিয়াদি পার্থক্য নেই। দেবকূলের জায়গায় গোঁড়া হিন্দুকূল বা সুবিধাভোগী ব্রাহ্মণকূল; আর তাঁরাই সমাজে সমস্ত সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে একচ্ছত্র আধিপত্য ভোগ করতেন। সুতরাং, একভাবে দেখতে গেলে শ্রেণিবিভাজিত যে সমাজব্যবস্থা তার বিরুদ্ধেই গর্জে উঠেছিল মাইকেলের কলম – এক এমন সমাজব্যবস্থা যেখানে মানুষ তার কাজের নিরিখে পরিচিত হতে পারে না, তার পরিচিত নির্ভর করে আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থার উপরতলার মানুষদের প্রতি আধিপত্যের উপর। হুবহু আজকের অবস্থা! যেখানে ‘সরকার’ আর ‘রাষ্ট্র’ সমার্থক। অতএব, সরকারবিরোধী কথা বললেই জুড়ে যাবে রাষ্ট্রদ্রোহীর তকমা। সেই সরকারের তোষামোদী ‘প্রচারমাধ্যম’ হয়ে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখো, ‘সংবাদমামধ্যম’ হয়ে ওঠার চেষ্টা কোরো না।

মাইকেলের এই প্রতিবাদী সত্ত্বার বিকাশ ১৮৪০-এর দশকে। যখন খ্রীষ্টধর্মে দীক্ষিত হয়ে পিতৃপ্রদত্ত মধুসূদন নামের আগে ‘মাইকেল’ বসিয়েছিলেন তিনি। তার কিছু আগে থেকেই অবশ্য মিল্টন এবং অন্যান্য পাশ্চাত্য চিন্তার সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল তাঁর। বলা ভালো, গোঁড়া ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দু সমাজের কূপমণ্ডূক হয়ে থাকতে চাননি তিনি। হয়তো সেই কারণেই বাঙালিদের মধ্যে প্রথম পাশ্চাত্য সাহিত্যের চর্চা করেছিলেন। তবে মাইকেল জানতেন, শুধু পাশ্চাত্য চিন্তার ধামাধারী হয়ে থাকলে বলবে না। সেই কারণেই তামিল বা তেলুগুর মতো দক্ষিণ ভারতীয় ভাষা আয়ত্ত করার প্রতি মনোযোগী হয়েছিলেন। এখানেও অনন্য মাইকেল। যে সময়ে ভারতবর্ষ বলতে মূলত বিন্ধ্য পর্বতের এপার বা আর্যাবর্তের উপর মনোনিবেশ করছেন সাহিত্যিক, ঐতিহাসিক এবং তথাকথিত ভদ্র সমাজের মানুষেরা, মাইকেল সেই সময়ই উপলব্ধি করেছিলেন, দক্ষিণ ভারতের সংস্কৃতি এবং কৃষ্টির সঙ্গে পরিচিত না হতে পারলে ভারতবর্ষের প্রকৃত রূপ জানা সম্ভব নয়। আর সেই উপলব্ধিগত কারণেই দীর্ঘদিন গিয়ে থেকেছিলেন চেন্নাই বা তৎকালীন মাদ্রাজে। যার জেরে বাংলা নবজাগরণের যুগে রামমোহনের পর মাইকেলই ছিলেন প্রথম মানুষ যিনি অন্তত আটটি ভাষায় নিজের পারদর্শিতা প্রমাণ করেছিলেন। ঠিক সেই সময়ই সংস্কৃতিগত দিক থেকে এক নতুন অভিজ্ঞতা হয়েছিল মাইকেলের। মাদ্রাজের যে অংশে তিনি থাকতেন ব্রিটিশ শাসকরা তার নাম দিয়েছিল ‘ব্ল্যাক টাউন’। এই ‘ব্ল্যাক টাউন’ নামের তাৎপর্য ছিল মূলত দু’ধরনের – প্রথমত, উত্তর ভারতের মানুষের থেকে দক্ষিণ ভারতের মানুষ কিছুটা শ্যামবর্ণের ছিলেন। দ্বিতীয়ত, ভারতে থেকে ‘নিগার’ বা ‘নেটিভ’ শব্দগুলিকে অনেক কাছ থেকে উপলব্ধি করার সুযোগ পেয়েছিলেন।

মনে রাখা প্রয়োজন, মাইকেল নিজে যথেষ্ট উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তান ছিলেন। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের লেখা তথ্যভিত্তিক উপন্যাস ‘প্রথম আলো’ এবং অন্যান্য সূত্র থেকে জানা যায়, ছাত্রজীবনে কখনও একই পোশাক দ্বিতীয়বার পরতেন না মাইকেল। এছাড়া, যে সময় তিনি হিন্দু কলেজে (বর্তমান প্রেসিডেন্সি বিশ্বিবিদ্যালয়) পড়তেন সেই সময় ছাত্রদের কলেজ ফি ছিল পাঁচ টাকা; অথচ সেই সময় দু’টাকা মাসিক বেতনে স্বচ্ছলভাবে সংসার চালাতেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের বাবা ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায়। কিন্তু খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ করে বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে আসার পর মাইকেল বুঝতে পেরেছিলেন অর্থাভাবের প্রবল যন্ত্রণা। আর একইসঙ্গে বুঝতে পেরেছিলেন, অর্থের জোগান যতই থাক না কেন, ভারতের মতো বর্ণবিদ্বেষ-পীড়িত দেশে ব্রিটিশ শাসনে ভারতীয়দের থাকতে হবে ‘কালা আদমি’ হিসাবেই। সেই অভিজ্ঞতাই সম্ভবত তাঁকে উদবুদ্ধ করেছিল ‘মেঘনাদবধ’ কাব্য লেখার জন্য।

ইওরোপে গিয়েও তিনি বেশিরভাগ সময় ইংল্যান্ডে না কাটিয়ে চলে গিয়েছিলেন ফ্রান্সে। উদ্দেশ্য ছিল, ফরাসিদের উৎকৃষ্ট ভাষা এবং সাহিত্যের সঙ্গে সুপরিচিত হওয়া। কিন্তু প্রবল আর্থিক সমস্যা দুর্বিষহ হয়ে দেখা দিয়েছিল সেই সময়। তবু তারই মধ্যে নিজের সাহিত্যচর্চা চালিয়ে গিয়েছেন মাইকেল। বাংলা সাহিত্যে চতুর্দশপদী বা পয়ার ছন্দের উদ্ভাবন হোক বা ইংরেজিতে ‘ব্ল্যাঙ্ক ভার্স’ – সবক্ষেত্রেই পরিচয় দিয়েছেন নিজের মুনশিয়ানার। উইলিয়াম শেক্সপিয়র, জন মিল্টন, উইলিয়াম ওয়ার্ডসওয়ার্থদের পাথেয় করে গড়ে তুলেছেন নিজেকে। অথচ, তারই মধ্যে মধ্যযুগীয় বর্বরতার সামিল হিন্দু সমাজব্যবস্থার প্রতি ছুঁড়ে দিয়েছেন ভর্ৎসনার তির – ‘একেই কি বলে সভ্যতা?’ এবং ‘বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রোঁ’ যার জ্বলন্ত প্রমাণ।

এতকিছুর পরেও মাইকেলকে বুঝতে পারেনি তৎকালীন হিন্দু বুদ্ধিজীবীমহল। কেউ মুখ ফিরিয়ে রেখেছেন মাইকেল বাংলা সাহিত্যের প্রতি উদাসীন বলে; কেউ বা তাঁকে তাচ্ছিল্য করেছেন ‘ম্লেচ্ছ’ দেশে যাওয়া এবং ‘কালাপানি’ পেরোনোর অপরাধে। ব্যতিক্রম ছিলেন কেবলমাত্র বিদ্যাসাগর। বিদেশে বসে মাইকেল টাকা নয়ছয় করছেন, মদ্যপানে আসক্ত হয়ে পড়ছেন জেনেও দিনের পর দিন টাকা পাঠিয়ে গিয়েছেন তাঁকে। কারণ, সেই সময়ে একমাত্র বিদ্যাসাগরই উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন মাইকেলের সাহিত্যচর্চার বিশেষত্ব। তাই মাত্র চার বছরের বড় হওয়া সত্বেও মাইকেলকে আগলে রেখেছিলেন কার্যত পিতৃস্নেহে। শোনা যায়, কোনও এক মদ্যপ একবার বিদ্যাসাগরের কাছে টাকা চাইতে এসেছিলেন। বিদ্যাসাগরের কাছে তাঁর দাবি ছিল, “মধুকে তো মদ খাওয়ার জন্য বিদেশে টাকা পাঠাও! তাহলে আমাকে মদ খাওয়ার জন্য টাকা দেবে না কেন?” বিদ্যাসাগর বলেছিলেন, “তুমি মধুর মতো কবিতা লিখতে পারো কি? যদি পারো তাহলে তোমাকেও টাকা দেব।“ মাইকেল সম্পর্কে এই ছিল তৎকালীন গড়পড়তা বাঙালির মনোভাব – মদ্যপ, লম্পট, উচ্ছৃঙ্খল। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মাইকেলকে বিচার করা হয়েছে তাঁর ব্যক্তিগত জীবিনের নিরিখে। রেবেকার সঙ্গে শান্তিময় দাম্পত্যজীবন ছেড়ে কেন তিনি হেনরিয়েটার সঙ্গে সম্পর্কে জড়ালেন, অবৈধ সন্তানের জন্ম দিলেন – নানা অভিযোগের তির মাইকেলের দিকে ছুঁড়েছেন নারীবাদী এবং অন্যান্য বুদ্ধিজীবীরা। কিন্তু ‘মেঘনাদবধ’ বা তাঁর অন্যান্য সাহিত্যকীর্তি নিয়ে আলোচনা সীমাবদ্ধ থেকে গিয়েছে শিক্ষামহল এবং সাহিত্যমহলের মধ্যেই। কারণ, মাইকেলের ভাষা বোঝার ক্ষমতাই বোধহয় এখনও অর্জন করে উঠতে পারেনি সাধারণ বাঙালি। ভুলে গিয়েছে, জীবনের শেষ পর্বে কলকাতায় ফিরে কি অবিস্মরণীয় সাহিত্যকীর্তির ছাপ রেখে গিয়েছেন তিনি। রায়গুণাকর ভারতচন্দ্র এবং ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের পর শৈল্পিকভাবে বাংলায় দ্ব্যর্থক ভাষা প্রয়োগ করে দেখিয়েছেন মাইকেলই। কিন্তু মাইকেলের মৃত্যুর প্রায় দেড়শো বছর পর তিনি নিজে এবং তাঁর সাহিত্য সাধারণের কাছে বিস্মৃতপ্রায়।

বিস্মৃত মাইকেলের চিন্তাধারাও। শহর কলকাতায় মাইকেলের বংশধর বলে যিনি পরিচিত সেই লিয়েন্ডার পেজই যেমন। প্রতিষ্ঠান, প্রাতিষ্ঠানিকতা এবং প্রাতিষ্ঠানিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার যে রাস্তা মাইকেল ‘মেঘনাদবধ’ কাব্যের মাধ্যমে দেখিয়ে দিয়েছিলেন, তার উল্টো পথে হাঁটছেন তাঁর উত্তরপুরুষ। গোয়ায় এখন তৃণমূল কংগ্রেসের ধ্বজাধারী এক চরিত্র; ‘পাইয়ে দেওয়ার রাজনীতি’-তে নাম-লেখানো এক চরিত্র। গোয়ায় ঘাস-ফুলের পতাকাবাহক হয়ে যদি শহর কলকাতায় নিজের টেনিস আকাদেমি করার মতো কিছু গুছিয়ে নেওয়া যায়!

সেই বিস্মৃতপ্রায়, প্রতিবাদী মানুষটির ১৯৮ বছরের জন্মদিনে সাধারণ মানুষ হিসাবে আমাদের চিন্তা একটাই – তাঁর কাব্যের নায়কের মতো প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর পথ দেখানো মাইকেল মধুসূদন দত্তও বাঙালির রাজনৈতিক চিন্তা ও চেতনার পরিসর থেকে হারিয়ে যাবেন না তো!

Spread the word

Leave a Reply