কুৎসার আড়ালে প্রকৃত সত্য – তাপসী মালিকের মৃত্যু রহস্য….

২০০৬ সালের ১৮ ডিসেম্বর সিঙ্গুরের বাজেমেলিয়া গ্রামের বাসিন্দা ১৬ বছরের কিশোরী তাপসী মালিকের মৃত্যুর খবর নিয়ে বাংলা জুড়ে যে আলোড়ন সৃষ্টি হয় তা সকলের নিশ্চয়ই স্মরণে আছে। সিঙ্গুরে টাটার প্রস্তাবিত গাড়ি কারখানার বিরুদ্ধে তখন বাংলার বাম বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো ব্যাপক আন্দোলনে শামিল হয়েছে। তারা এই ১৬ বছরের কিশোরীর মৃত্যুকে একটি রাজনৈতিক হত্যা বলে তীব্র প্রচার শুরু করে এবং তাপসী মালিককে জমি আন্দোলনের নেত্রী ও শহীদ আখ্যা দেওয়া হয়। পরবর্তী ঘটনাক্রম বাংলার মানুষের জানা। তাপসী মালিকের মৃতদেহের দগ্ধ ও বীভৎস ছবি চারিদিকে প্রচার করে সিপিআই(এম)কে তাপসী মালিকের খুনি বলে সাব্যস্ত করার চেষ্টা হয়। রাজ্য সরকার এই মৃত্যুর কিনারা করবার জন্য প্রথমে সিআইডিকে দায়িত্ব দেয় এবং কয়েকমাস পর সিবিআইয়ের হাতে তদন্তের ভার তুলে দেওয়া হয়।  সিবিআই এর তদন্ত প্রক্রিয়া শুরু থেকেই ছিল নানা রকম অসঙ্গতিতে ভরা। পুরো তদন্তের ক্ষেত্রে যে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার মতলব ছিলো তা পরবর্তীকালের ঘটনাক্রম পর্যালোচনা করলে সহজেই বোঝা যায়। তাপসী মালিকের হত্যার জন্য সি পি আই (এম) এর সিঙ্গুর জোনাল কমিটির সম্পাদক সুহৃদ দত্ত এবং স্থানীয় পার্টিকর্মী দেবু মালিককে গ্রেপ্তার করা হয়। চন্দননগর ফাস্ট ট্রাক কোর্টে শুনানির পর দু’জনকেই যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের আদেশ দেয় আদালত। নিম্ন আদালতের এই রায়ে সন্তুষ্ট না হয়ে উচ্চতর আদালতে অভিযুক্তদের আইনজীবীরা আপিল করলে আদালত সেই আপিল মঞ্জুর করে এবং দু’জনকে জামিনে মুক্ত করে। এখনো সেই মামলা চলছে। তাপসী মালিকের মৃত্যু নিয়ে কোনো চূড়ান্ত রায় না বেরোনো সত্বেও  বাম বিরোধীরা মিথ্যে অভিযোগের পুনরাবৃত্তি করে সিপিআই(এম)কে কালিমালিপ্ত করে চলেছেন।



তাপসী মালিকের মৃত্যু ও কিছু জরুরি প্রশ্ন



তাপসী মালিক এর মৃতদেহ সিঙ্গুরে প্রস্তাবিত গাড়ি কারখানার প্রোজেক্ট এরিয়ার মধ্যে পাওয়ার ঘটনাকে বিরোধীরা হাতিয়ার করে। তাপসীকে জমি আন্দোলনের নেত্রী বলে দাবি করা হয় যে তাপসীদের জমি গাড়ি কারখানার জন্য অধিগ্রহণ করা হয়েছিল বলে তাপসী আন্দোলন করেছিলেন আর তার মাশুল নাকি তাকে এভাবে জীবন দিয়ে চোকাতে হয়েছিল। প্রথমত, শুনানির সময় তাপসের বাবা মনোরঞ্জন মালিক স্বীকার করেন যে তিনি মাছ বিক্রেতা এবং তাদের কোন জমি ছিল না। এও প্রমাণিত হয় যে তারা কারোর জমিতে চাষও করতেন না,যদিও তাপসীর বাবা এমন সব ভুয়ো দাবী প্রথমে করেছিলেন। আর জমি আন্দোলনের নেত্রী হিসেবে তাপসীর নামও কখনো উচ্চারিত হয়নি। মৃত্যুর পরেই তাকে ঘিরে এই ধরনের প্রচার শুরু করে তৃণমূল কংগ্রেস সহ বাম বিরোধী শক্তি।আর তাদের সুরে সুর মিলিয়ে সিবিআই চার্জশিটে তাপসীকে জমি আন্দোলনের নেত্রী বলে উল্লেখ করে। জমি অধিগ্রহণের সাথে তাপসী মালিকের মৃত্যুকে জুড়ে দেওয়ার এই ঘৃণ্য চক্রান্ত আদালতে শুনানির সময় উন্মোচিত হয়ে যায়।


অভিযোগকারীদের বয়ান অনুযায়ী তাপসী সকালবেলা প্রাতঃকৃত্য করবার জন্য ভোর চারটের সময় বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায় এবং সকালবেলা তার মৃতদেহ মেলে দগ্ধ অবস্থায়। এই অভিযোগের ক্ষেত্রেও প্রথম অসঙ্গতি এখানেই যে তাপসীর ঘর সংলগ্ন একটি পাকা শৌচালয় ছিল। পাকা শৌচালয় বাদ দিয়ে সে খোলা মাঠে কেন প্রাতঃকৃত্য করতে যাবে?  সিবিআইয়ের তদন্তকারী অফিসার পার্থসারথি বসু যে  বিরোধীদের সঙ্গে জোট করে সিপিআইএমকে কালিমালিপ্ত করার চেষ্টা করেছিলেন তাঁর অসংখ্য প্রমাণ রয়েছে। তিনি নিজে তাপসীদের বাড়িতে পাকা শৌচালয় দেখা সত্বেও সেকথা চার্জশিটে উল্লেখ করেননি। তিনি চার্জশিটে দাবি করেন যে  প্রাতঃকৃত্য করবার জন্য বেরোনোর পরে পরেই তাকে খুন করা হয় অর্থাৎ সে ক্ষেত্রে তাপসীর শরীরের ময়নাতদন্ত হওয়ার পর শরীরে মল,মূত্রের অস্তিত্ব থাকার কথা।ড: টি কে বসুর করা ময়নাতদন্ত রিপোর্টে সেরকম কোন কিছু ছিল না।


আর ভোরবেলা যখন তার মৃত্যু হয়েছিল বলে দাবি করা হয় তখন সেই এলাকায় যারা নৈশ প্রহরীর কাজ করছেন তারাও কোনো প্রাণ বাঁচানোর জন্য চিৎকার শোনেননি। যারা সেই সময় ভোর বেলায় ট্রেন ধরতে স্টেশনে যান তাদের কানেও এমন কোন আওয়াজ আসেনি।আরো আশ্চর্যের বিষয় এখানেই যে তাপসীর মৃতদেহ পুড়তে দেখেও তাপসীর বাবা,মা,স্থানীয় পঞ্চায়েত প্রধান হারাধন বাগ আগুন নেভানোর  জন্য জল এনে মৃতদেহ ঢালবার চেষ্টা করেননি অথচ পুকুর কাছেই ছিল।

সিবিআই চার্জশিটে বলা হয় যে তাপসী বাড়ি থেকে বেরোনোর পর চারজন ব্যক্তি তাকে পাকড়াও করে, দুজন তাকে ধর্ষণ করে এবং একজন তার মাথায় গাছের ডাল দিয়ে আঘাত করে। তখন সেই ক্ষতস্থান থেকে রক্ত নাকি ৩০/৪০ হাত দূরে দাঁড়ানো দেবু মালিকের প্যান্টে লাগে।দেবু মালিককে নাকি তাপসী চিনতে পেরে আর্তনাদ করে ওঠে। এরপর সিবিআই দেবু মালিকের তিনটি প্যান্ট আদালতে পেশ করে যাতে রক্ত লেগে আছে। প্রশ্ন ওঠে যে ৩০/৪০ হাত দূরে থাকা ব্যক্তিকে ঘন অন্ধকারের মধ্যে চেনা কি আদৌ সম্ভব? আর দ্বিতীয় প্রশ্ন এই যে অতদূরে রক্তের ছিটে লাগল কি করে? আর তৃতীয় ও খুব জরুরি প্রশ্ন এই যে দেবু মালিক কি সেদিন তিনটি প্যান্ট পরেছিলেন ?  আরো আশ্চর্যের বিষয় এই ‘রক্তমাখা’ তিনটি প্যান্ট দেবু মালিকের বাড়ি থেকে ঘটনার চার মাস বাদে উদ্ধার করে সিবিআই!

তাপসী মালিকের মৃত্যুর ঘটনায় সি বি আই এর চার্জশিট  সিপিআই(এম)কে অপরাধী প্রমাণ করার জন্য তৈরি করা এমনই এক অলীক চিত্রনাট্য।

মৃতদেহের ময়না তদন্তে দেখা যায় যে তাপসীর মাথায় পাঁচটি আঘাতের চিহ্ন ছিল কিন্তু এসব আঘাতের জন্য মস্তিষ্কে আভ্যন্তরীণ রক্তক্ষরণ হয়ে রক্ত জমাট বেঁধে ছিল। কোন রক্তই বাইরে বেরোয় নি।তাহলে দেবু মালিকের প্যান্টে রক্ত এলো কোথা থেকে আর তাও ঘটনার চার মাস পর? এসব যাবতীয় প্রশ্ন অভিযুক্তের আইনজীবীরা নিম্ন আদালতে উত্থাপন করলেও তার কোনো যুক্তিসঙ্গত উত্তর সিবিআই এর পক্ষ থেকে দেওয়া হয়নি। প্রশ্ন উঠেছে যে আদৌ কি ২০০৬ সালের ১৮ ডিসেম্বর সকালে তাপসী মালিকের মৃত্যুস্থলে দেবু মালিক ছিলেন? কারণ, তিনি যে বাড়িতে থাকতেন সেই বাড়ির মালিক সিবিআই এর অন্যতম সাক্ষী রমেন দাস বলেন যে ভোরবেলা তিনি দেবুকে তার ঘরে ঘুমিয়ে থাকতে দেখেন।


অত্যন্ত উদ্বেগের বিষয় এই যে নিম্ন আদালতে এই গুরুতর অসঙ্গতি গুলি  যথাযথভাবে বিচার করা হয়নি এবং অভিযুক্তদের যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের  সাজা শোনানো হয়েছিল।


তাপসী মালিক ধর্ষিতা হয়েছিলেন বলে ব্যপক প্রচার করা হয়েছিল। কিন্তু ধর্ষণের প্রমাণ আছে কিনা তা খতিয়ে দেখার জন্য তাপসীর সোয়াব টেস্টের রিপোর্ট তৎকালীন কলকাতা মেডিক্যাল কলেজের  ফরেনসিক বিভাগের প্রধান ড:এ কে গুপ্ত সি বি আই এর কাছে চাইলেও সিবিআই  সেই রিপোর্ট তাকে দেয়নি।  ডক্টর গুপ্ত জানিয়েছিলেন যে তাপসীর মরদেহের ময়না তদন্তের রিপোর্ট ও ময়নাতদন্ত চলাকালীন তোলা ছবি দেখে তার মনে হয়েছিলো যে এই কিশোরীর মৃত্যুর কিছুদিন আগে গর্ভপাত করানো হয়েছিল।আদালতকে ডক্টর গুপ্ত এই সব কিছুই জানান। এর সুত্রে আরো একজন সাক্ষী বাজেমেলিয়া গ্রামের বাসিন্দা উদয় শংকর দাসের বয়ান খুব গুরুত্বপূর্ণ কারণ তিনি ১৮ ডিসেম্বর তাপসীর মৃত্যুর কয়েক দিন আগে তাপসীকে উদ্ভ্রান্ত ও উত্তেজিত অবস্থায় কামারকুন্ডু স্টেশনে দেখেছিলেন। তিনি আদালত কে জানান যে তাপসীর বাবা ও ভাই,গ্রামের কয়েকজনের সাহায্যে  অনেক সাধ্য সাধনা করে তাকে সেখান থেকে নিয়ে যায়। তাপসীর পরিবারে অশান্তি চলছিল এবং তাপসীর মৃত্যুর সাথে এর কোন যোগাযোগ আছে কিনা তা খতিয়ে দেখার কোনো চেষ্টা করেনি সিবিআই। বোঝাই যায় যে তাপসীর মৃত্যু কেন হয়েছিল তা জানার বদলে তার মৃত্যুর জন্য বিশেষ কাউকে দায়ী করাই সিবিআই এর উদ্দেশ্য ছিলো।সিবিআইয়ের তদন্তকারী অফিসার পার্থসারথি বসু পরবর্তীকালে দুর্নীতির অভিযোগে গ্রেপ্তার হন। এহেন অসাধু ব্যক্তির তৈরি করা ভুলে ভরা চার্জশিটকে পুঁজি করে সারা রাজ্যে সিপিআইএম বিরোধী জিগির তোলে বাম বিরোধীরা।

দিল্লির চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট এম যদুবংশীর আদালতে দেবু মালিকের গোপন স্বীকারোক্তি বলে যাকে চালানোর চেষ্টা করেছে সি বি আই তা নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠেছে। প্রথমত দেবু মালিক কোর্টকে জানিয়েছিলেন যে তিনি সিবিআই কে কোন গোপন জবানবন্দি দেন নি।  সিবিআই যাকে দেবু মালিকের তথাকথিত বাংলা জবানবন্দির ইংরেজি অনুবাদক হিসেবে কোর্টের কাছে হাজির করেছিল সেই অনুবাদক কোহিনা সরকার কোন স্বীকৃত দোভাষী নন এবং তার বাংলা ভাষার উপর দখলও যথেষ্ট দুর্বল। দ্বিতীয়তঃ এই জবানবন্দির প্রতিটি পাতায় তদন্তকারী অফিসারের স্বাক্ষর ছিল। গোপন জবানবন্দি যদি নেওয়াও হয়ে থাকে সেক্ষেত্রে গোপন জবানবন্দি দেওয়ার সময় তদন্তকারী অফিসার থাকতে পারেন না। সেক্ষেত্রে ফৌজদারি বিধি লঙ্ঘন করা হয় এবং গোপন জবানবন্দিটিরও কোনো আইনি স্বীকৃতি থাকেনা।


তাপসী মালিক হত্যার ঘটনায়  অভিযুক্তদের সম্মতি এবং আদালতের অনুমোদন ছাড়াই পলিগ্রাফ টেস্ট করিয়ে সিবিআই আরো একটি গুরুতর আইন ভঙ্গ করে। আর পলিগ্রাফ টেস্টে যে প্রশ্নগুলি করা হয়েছিল তার ধরন দেখেই বোঝা যায় যে তাপসী মালিকের মৃত্যুর কারণ নয় সিপিআই(এম)কে অভিযুক্ত করাই ছিল এই পলিগ্রাফ টেস্ট এর উদ্দেশ্য।
তাপসী মালিকের মৃত্যুর জন্য অভিযুক্ত সিপিআই(এম) নেতা সুহৃদ বরণ দত্তকে দীর্ঘ দিন কারাবাস করতে হয়। সেখানে এই বৃদ্ধ নেতার নানা রকম শারীরিক সমস্যা দেখা দেয়। আজ তিনি ব্যাধি জর্জরিত শরীরে দিনযাপন করছেন। এই কুৎসিত রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রে  বামফ্রন্ট বিরোধী শক্তির দোসর ছিল সিবিআই। পশ্চিমবঙ্গে শিল্পায়নের প্রক্রিয়াকে বানচাল করবার জন্য এই জঘন্য ষড়যন্ত্র ইতিহাসের পাতায় কলঙ্কিত অধ্যায় হিসেবে লেখা থাকবে।

Spread the word

Leave a Reply