MayDay Tapan Sen

Significance Of May Day: The Indian Perspective

মে দিবসের তাৎপর্য

মে দিবসের একটা চিরন্তনী তাৎপর্য আছে।

কাজের ঘণ্টাকে সীমায়িত করা, ১লা মে ১৮৮৬ সালের ৫৩ বছর আগে থেকেই এই কাজের ঘন্টা কমানোর দাবি উঠতে শুরু করে। আট ঘন্টা কাজ, আট ঘন্টা বিশ্রাম এবং আট ঘন্টা বিনোদন। এটা ছাড়া মানুষ বাঁচতে পারেন না। এই দাবিতে আন্দোলন শুরু হয়েছিল সারা পৃথিবী জুড়েই। শিকাগো শহরে প্রথম দাবি সম্মত প্রতিশ্রুতি পালন সম্ভব হয়েছিল। পুঁজির বিরুদ্ধে শ্রমের নিরন্তর সংঘর্ষকে এই আন্দোলনে মূর্ত রূপে দেখা যায়।

শ্রম সময় যা উদ্বৃত্ত মূল্য সৃষ্টিতে অন্যতম ভূমিকা পালন করে, সেই সম্পর্কে শ্রমিক শ্রেণীর সচেতন রাজনৈতিক অবস্থান মে দিবসের লড়াই। ইউরোপের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে সংগঠিত আন্দোলনগুলো শেষে শিকাগোতে একটি সুসংহত রূপ নেয়। সেই আন্দোলন-সংগ্রামের ধারা আজকের দিনে এক নতুন মাত্রায় উন্নীত হয়েছে। আজ আটঘন্টা কাজের সময় ধারণা আক্রান্ত।

মহামারীর দুই পর্বেই শাসকশ্রেণীর আক্রমণের প্রথম নিশানা শ্রমিকদের কাজের ঘণ্টার বিষয়। তাদের দাবি শ্রমিকদের কাজের সময় বাড়িয়ে ১২ ঘন্টা করা হোক। সেই মতো বিভিন্ন কাজের জায়গায় নোটিশ পর্যন্ত জারি করা হয়েছে। বহু আন্দোলন সংগ্রামের ফসল হিসেবে অর্জিত শ্রমিক অধিকার আইনগুলি এককথায় নাকচ করে কিংবা বলে চলে খারিজ করে দেশের সংসদে অধ্যাদেশ জারি করা হয়েছে। এইসবই করা হয়েছে আপৎকালীন অবস্থার অজুহাত হিসাবে। নয়া শ্রম আইন প্রণয়ন করে আসলে দেশের শ্রমিক শ্রেণীর অর্জিত অধিকারগুলিকে সরাসরি অস্বীকার করা হয়েছে। সংশোধিত শ্রম আইনে অন্যতম বিষয়ই হলো শ্রমসময়। দেশজুড়ে শ্রমিক কর্মচারী মজদুরদের প্রতিরোধ আন্দোলনের ফলে এখনো সার্বিকভাবে নয়া শ্রম আইন কার্যকরী চেহারায় প্রণীত হয়নি। আমাদের দেশে শ্রমজীবী মানুষের চেতনায় ৮ ঘণ্টা কাজের দাবি স্বাভাবিক দাবি হিসেবে উপস্থিত থাকায় কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষে নয়া আইনের নামে শোষণ চাপিয়ে দেওয়া যতটা ভাবা হয়েছিল ততটা সহজ নয়। কর্ণাটক, তামিলনাড়ু, মহারাষ্ট্র এইসব রাজ্যে নয়া শ্রম আইন লাগু করার চেষ্টা হয়, বহু বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে শ্রমিকরা এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ সংগঠিত করেন, দেশজোড়া ধর্মঘট পালিত হয়।

মোদী সরকার দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় এসে জঘন্য কায়দায় কর্পোরেট এবং মুনাফাজীবীদের স্বার্থরক্ষা করে চলেছে। গোটা দেশের জনগণের স্বার্থের বদলে কর্পোরেট, মুনাফাখোর গোষ্ঠীর সুবিধা যুগিয়ে দেওয়াই আজকের ভারতে আর্থিক সংস্কার। সংস্কারের পথে যেমন নয়া কৃষি আইন জারি করা হয়েছে, তেমনই বাতিল করা হয়েছে বহু সংগ্রামে অর্জিত এবং প্রচলিত শ্রম আইনসমূহ। পাঁচরাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন, পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূলের শাসনকালে মানুষ বিপর্যস্ত— এই পরিস্থিতিতে কেন্দ্রীয় আইনসমূহের পরিবর্তনের ফলে গোটা দেশসহ আমাদের রাজ্যে লক্ষ লক্ষ মানুষের কাজের সুযোগ ধ্বংস হতে চলেছে।

আগামী ১৫, ১৬ মার্চ ব্যাংক ইউনিয়নগুলি ধর্মঘটের আহ্বান জানিয়েছে, ১৭ এবং ১৮ মার্চ জীবনবীমা এবং সাধারণ বীমা ইউনিয়নের পক্ষ থেকে পালিত হবে ধর্মঘট। শ্রমিকদের নিরাপত্তা, অধিকার, কাজের নিরাপত্তা, কাজের সুযোগ সবকিছুতেই কেন্দ্র এবং রাজ্য উভয় সরকারই ব্যর্থ। গতবছর মার্চ মাসে লকডাউন ঘোষণা করে একদিকে সারাদেশে শ্রমজীবী মানুষদের ভয়ানক দুর্দশায় ঠেলে দেয় কেন্দ্রের মোদী সরকার। অন্য রাজ্য থেকে কাজ হারিয়ে, মাথার উপরে ছাদ হারিয়ে, খাবারের অভাবে পীড়িত, চিকিৎসার সুযোগ না পাওয়া এইসব অসংখ্য মানুষের কোনও দায়িত্ব রাজ্যের তৃণমূল সরকারও নেয়নি।

অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমজীবীরা তো বটেই, কেন্দ্রীয় সরকারের নয়া চার শ্রম কোডের ধাক্কায় সংগঠিত ক্ষেত্রের কর্মচারীরাও গভীর সংকটে। লাগামছাড়া বেসরকারিকরণ, রাষ্ট্রায়ত্ব সংস্থা বিক্রি এবং জাতীয় সম্পদের বেনজির লুট— এই হল আজকের ভারতে কেন্দ্রীয় সরকারের অর্থনৈতিক ভূমিকা। ব্যাংক, বীমাসহ সমস্ত সংগঠিত এবং অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমজীবী মানুষ কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নগুলির ডাকে এই সংকটের বিরুদ্ধে লড়াই করছেন, গত বছরের ২৬ নভেম্বর দেশজুডে ঐতিহাসিক ধর্মঘট পালিত হয়েছে।২০১৯ সালে কেন্দ্রীয় সরকার পাশ করেছে কোড অন ওয়েজেস। ২০২০ সালের বাদল অধিবেশনে পাশ করিয়ে নেওয়া হয়েছে আরও তিনটি শ্রম আইন – ক) দ্য ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিলেশন কোড, খ) দ্য অক্যুপেশনাল সেফটি, হেলথ অ্যান্ড ওয়ার্কিং কন্ডিশন্স কোড এবং গ) কোড অন সোশ্যাল সিকিউরিটি। এই সবকটি শ্রম আইনের দ্বারা একদিকে মালিকপক্ষের স্বার্থরক্ষা যেমন সুনিশ্চিত করা হল, তেমনই অন্যদিকে ভারতে সংগঠিত এবং অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিক-কর্মচারীদের যাবতীয় অধিকারকেই বাতিল করা হয়েছে, খারিজ করে দেওয়া হয়েছে ২৯টি শ্রম আইন।

প্রভিডেন্ট ফান্ড এমনই একটি সুবিধা যার সাহায্যে অবসর গ্রহনের পরে শ্রমিক কর্মচারীরা নিজেদের দিনগুজরান করার মতো আর্থিক সংস্থানের সুবিধা পেতেন। মোদী সরকার সেই সুযোগ তুলে দিতে বদ্ধপরিকর। পাশ করিয়ে নেওয়া নতুন চার শ্রম আইনের মধ্যে শেষ অর্থাৎ কোড অন সোশ্যাল সিকিউরিটি অ্যাক্টের মধ্যে দিয়ে ৯টি শ্রম আইন খারিজ করা হয়েছে। সেই আইনগুলি হল ১) এমপ্লয়িজ কম্পেন্সেশন অ্যাক্ট, ২) এমপ্লয়িজ স্টেট ইন্স্যুরেন্স অ্যাক্ট, ৩) এমপ্লয়িজ প্রভিডেন্ট ফান্ড অ্যান্ড মিস্লেনিয়াস প্রভিশন্স অ্যাক্ট, ৪) এমপ্লয়মেন্ট এক্সচেঞ্জ (কম্পালসরি নোটিফিকেশন অফ ভ্যাকেন্সি) অ্যাক্ট, ৫) মেটারনিটি বেনিফিট অ্যাক্ট, ৬) পেমেন্ট অফ গ্রাচ্যুইটি অ্যাক্ট, ৭) সিনে ওয়ার্কার্স ওয়েলফেয়ার ফান্ড অ্যাক্ট, ৮) বিল্ডিং অ্যান্ড আদার কন্সট্রাকশন ওয়ার্কার্স ওয়েলফেয়ার সেস অ্যাক্ট এবং ৯) আন- অর্গানাইজড ওয়ার্কার্স সোশ্যাল সিক্যুরিটি অ্যাক্ট। বাতিল হওয়া এই ৯টি বিভিন্ন আইনের নাম থেকেই স্পষ্ট বোঝা যায় শ্রমিক-কর্মচারীদের কল্যানে যাবতীয় আইনকেই সংস্কারের লক্ষ্য করা হয়েছে। আসলে মালিকপক্ষ চায় মুনাফার নিশ্চয়তা, সেই কাজে সবচেয়ে সহজ উপায় কর্মরত শ্রমিক-কর্মচারীদের শোষণ। হায়ার অ্যান্ড ফায়ার মানে যখন খুশি নিয়োগ, যখন খুশি ছাঁটাই— পুঁজিবাদের খুবই পছন্দের পরিকল্পনা। উৎপাদন বাড়িয়ে নেবার সময় মর্জিমাফিক মজুরির ভিত্তিতে চুক্তিতে নিয়োগ করে পরে ইচ্ছামতো ছাঁটাই— এই হল পুঁজিবাদের মতে অবাধ বাণিজ্যের শর্ত। পুঁজিবাদ এমন শোষণের ব্যবস্থাকেই জায়েজ এবং উপযুক্ত বলে যুক্তি হাজির করে কারন এতে মুনাফা বাড়িয়ে নেবার সবচেয়ে সহজ রাস্তাটা খোলা থাকে— সেই রাস্তা হল ১) শ্রমিকদের মজুরি কমানো, ২) খুবই কম অথবা বিনা মজুরিতে শ্রমসময় বাড়িয়ে নেওয়া এবং ৩) স্থায়ী শ্রমিকের বদলে ঠিকা শ্রমিক নিয়োগ। কেন্দ্রীয় সরকারের নয়া শ্রম আইন সেই লক্ষ্যেই কাজ করেছে।

আজকের কর্পোরেটরা শোষণের ঐতিহাসিক সমস্ত চেহারাকেই ছাপিয়ে উঠে নতুন নজির তৈরি করেছে—লকডাউনের ধাক্কায় সারা দেশে কাজ হারানো মানুষের সংখ্যা প্রায় ১ কোটি ৭৭ লক্ষ। অথচ সেই সময়েই দেশের কর্পোরেটগোষ্ঠীর মুনাফা বেড়েছে! শোষণের এই ব্যবস্থাকেই পাকা চেহারা দিতে প্রচলিত শ্রম অধিকারগুলি কেড়ে নেওয়া প্রয়োজন, তাই নয়া শ্রম আইন প্রণয়ন হয়েছে।

পাশ হওয়া চার শ্রম কোডের আরেকটি আইন “অক্যুপেশনাল সেফটি, হেলথ অ্যান্ড ওয়ার্কিং কন্ডিশন্স কোড” ব্যাপারটা কি? ২০২০ সালের ২৮শে সেপ্টেম্বর কেন্দ্রীয় সরকারের বিজ্ঞপ্তিতে এই আইন সম্পর্কে An Act to consolidate and amend the laws regulating the occupational safety, health and working conditions of the persons employed in an establishment and for matters connected therewith or incidental thereto বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

কাজের সময় শ্রমিক-কর্মচারীদের স্বাস্থ্যহানী, স্বাস্থ্যবিষয়ক সাধারণ সুযোগ-সুবিধাসমূহ এবং কাজের জায়গায় স্বাস্থ্যকর পরিবেশ এই হল উপরোক্ত আইনের পরিসর। যদিও ছিয়াশি পৃষ্ঠার সেই বিজ্ঞপ্তিতে অনেক জায়গাতেই বিভ্রান্তি রয়েছে। সেইসব বিভ্রান্তির উদ্দেশ্য যদিও স্পষ্ট, মালিকপক্ষকে আইনী জটিলতার সুবিধা পাইয়ে দেওয়া।

প্রথমেই উল্লেখ করতে হয় কলকারখানা বা ফ্যাক্টরির সংজ্ঞা। আইনের বিজ্ঞপ্তিতে লেখা রয়েছে “factory” means any premises including the precincts thereof— (i) whereon twenty or more workers are working, or were working on any day of the preceding twelve months, and in any part of which a manufacturing process is being carried on with the aid of power, or is ordinarily so carried on; or (ii) whereon forty or more workers are working, or were working on any day of the preceding twelve months, and in any part of which a manufacturing process is being carried on without the aid of power, or is ordinarily so carried on… বিদ্যুৎ ব্যবহার করে এবং করে না দুটি ক্ষেত্রেই শ্রমিকদের সংখ্যা আগে যা ছিল তার দ্বিগুন করে দেওয়া হয়েছে। গোটা দেশে ২০ জনের কম শ্রমিক নিয়ে বিদ্যুৎ ব্যবহার না করা ছোট ফ্যাক্টরি বা কাজের জায়গা প্রচুর। নয়া আইনে তারা সকলেই স্বাস্থ্য এবং সুরক্ষা আইনের সুবিধা থেকে বঞ্চিত হবেন। ফ্যাক্টরিতে বিদ্যুৎ ব্যবহৃত হয় এবং মোট শ্রমিক- কর্মচারীর সংখ্যা চল্লিশের কম এমন কারখানার সংখ্যাও ভারতে অনেক— এদের সকলকেই জোর করে সুযোগ সুবিধা থেকে সরিয়ে দেওয়া হল। এতে কার সুবিধা হবে? কার উন্নয়ন হবে? নয়া আইনে অবাধে ঠিকা শ্রমিক নিয়োগের সুযোগ দেওয়া হয়েছে।

বর্তমানে দেশের রাষ্ট্রায়ত্ত্ব শিল্পে মোট শ্রমিক – কর্মচারীর পঞ্চাশ শতাংশই অস্থায়ী বা ঠিকায় নিযুক্ত। এমনকি বহু স্থায়ী পদেও এদের কন্ট্র্যাক্টরের অধীনে চুক্তির ভিত্তিতে নিয়োগ করা হয়। আগে ২০ জনের কম শ্রমিক নিয়োগ করে এমন কোন কন্ট্র্যাক্টরের লাইসেন্স প্রয়োজন হতো না, এখন ৫০ জন অবধি নিয়োগে লাইসেন্সের প্রয়োজন হবে না। এতে কন্ট্র্যাক্ট্রদের হাতে আরও বেশী শ্রমিক শোষণের শিকার হবেন। অথচ দাবী ছিল স্থায়ী কাজে ঠিকা শ্রমিক নিয়োগ না করার, স্থায়ী কাজে নিযুক্ত ঠিকা শ্রমিকের বেতন স্থায়ী কর্মীর দেতনের সমান করার। আইনসম্মত বেতন এবং অন্যান্য সুযোগসুবিধাসহ শ্রমিকদের কল্যানে (ওয়েলফেয়ার) মূল কারখানার মালিক (প্রিন্সিপ্যাল এমপ্লয়ার)-দের যে দায় এতদিন বলবৎ ছিল তাকে নয়া আইনে লঘু করা হল— আইন প্রণয়নের দ্বারা শ্রেণীস্বার্থ চরিতার্থের জ্বলন্ত উদাহরন। পেরেনিয়াল ওয়ার্ক মানে সারা বছর কাজের সুযোগ থাকে এমন কাজে ঠিকা শ্রমিক নিয়োগের ক্ষেত্রে আগে ঠিকা শ্রমিক যুক্ত করতে আইনি বাধা ছিল, এখন কোর অ্যাক্টিভিটির আড়ালে সেই বিধিনিষেধ তুলে দেওয়া হল।

মোদী সরকার ২০১৯ সালেই মজুরি সংক্রান্ত আইন সংস্কার করেছিল। সেইসময় সরকারের প্রস্তাবে সংশোধনের দাবী করেছিল বামপন্থী সাংসদেরাই, সংশোধনী চেয়ে আইনসভায় ৮টি ভোট পড়েছিল যার ছটিই বামপন্থী সাংসদদের। এর আগে ২০১৮ সালে শ্রম সংক্রান্ত সংসদীয় স্ট্যান্ডিং কমিটি কিছু প্রস্তাব করেছিল, মোদী সরকার সেইসব সুপারিশে কোন আমলই দেয়নি। ভর্তুকিহীন রান্নার গ্যাসের দাম বেড়ে ৮৪৫ টাকা প্রতি সিলিন্ডার হলে কেন মানুষের দুর্দশার শেষ থাকে না অথবা পেট্রোপণ্যের দাম বেড়ে গিয়ে সবকিছুর (পণ্য এবং পরিষেবা) দাম বাড়লে কেন তা জনজীবনে দুর্ভোগ নামিয়ে আনে এটুকু বোঝার মতো সংবেদনশীল নয় এই সরকার। ২০১৯ সালে মোদী সরকার বেতন সংক্রান্ত কোড অন ওয়েজেস নিয়ে এসে একধাক্কায় চারটি আইন ক) পেমেন্ট অফ ওয়েজেস, খ) মিনিমাম ওয়েজেস অ্যাক্ট, গ) পেমেন্ট অফ বোনাস অ্যাক্ট এবং ঘ) ইক্যুয়াল রেমুনারেশন অ্যাক্ট বাতিল করে দিয়েছে। তাদের বক্তব্য বেতন সংক্রান্ত সমস্ত আইনকে একটি আইনের আওয়তায় নিয়ে আসাই সরকারের উদ্দেশ্য।

এতকিছু বলার পরে ২০১৯’এর জুলাই মাসে কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে দিন প্রতি ১৭৮ টাকা ন্যুনতম মজুরি নির্ধারিত হয়েছে! এই মজুরির নাম দেওয়া হয়েছে ফ্লোরলেভেল ওয়েজ! ভারতের কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল এবং অন্যান্য ৩১টি বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে ন্যুনতম মজুরিও এর চাইতে অনেকটা বেশী! বুঝতে সমস্যা হয় না এই সরকার কাদের কথা ভেবে কাজ করছে। আইনের ভাষায় আরও কিছু সমস্যা দেখ দিয়েছে, যদিও একটু ভাবলেই বোঝা যায় সেই ভাষাগত দ্বিধার প্রধান কারন রাজনীতি এবং অবশ্যই শ্রেণী রাজনীতি।

আইনের একজায়গায় লেখা হয়েছে এমপ্লয়ী (কর্মচারী) আরেকজায়গায় রয়েছে ওয়ার্কার (মজদুর)। এতে সমস্যা কোথায়? আইনের ফাঁকটুকু কাজে লাগিয়ে এক বিরাট অংশের কর্মরত জনগণকে বিভিন্ন সুযোগসুবিধা থেকে খুব সহজেই সরিয়ে রাখা যাবে, মালিকদের খরচ কমবে, মুনাফা আরও বাড়বে। সংসদের শ্রমবিষয়ক স্ট্যান্ডিং কমিটি এই সমস্যাকে নির্দেশ করে ইতিমধ্যেই প্রস্তাব করেছে। সেই প্রস্তাব কেন্দ্র সরাসরি উপেক্ষা করেছে। শ্রমিক-মজদুর, মেহনতি মানুষের বহু সংগ্রামে অর্জিত অধিকারগুলি সর্বদাই কেড়ে নিতে চেয়েছে, অর্থনৈতিক সংস্কার, পুঁজি বিনিয়োগের পরিবেশ এইসব অজুহাতে পুনরায় দাসত্বের শৃঙ্খলে বাঁধতে চায়। ভারতে পুঁজিবাদের হয়ে সেই কাজই করছে মোদী সরকার। ১. ট্রেড ইউনিয়ন অ্যাক্ট, ২. ইন্ডাস্ট্রিয়াল এমপ্লয়মেন্ট স্ট্যান্ডিং অর্ডার অ্যাক্ট এবং ৩. ইক্যুয়াল রেমুনারেশন অ্যাক্ট – প্রচলিত এই তিনটি আইনকেই বাতিল করে দিয়ে ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিলেশনস কোড-২০২০ প্রণয়ন করা হয়েছে। সরকার বলছে নয়া আইনে শ্রমসম্পর্ক নমনীয় হবে ফলে বিপুল পরিমাণ পুঁজি চীন থেকে ভারতে ঢুকবে। এক কথায় বলা যায় সরকার মিথ্যা দাবী করছে, সম্প্রতি ভারত-চীন সীমান্তবর্তী এলাকায় দুইদেশের মধ্যে কূটনৈতিক সমস্যার সুযোগকে কাজে লাগিয়ে আমাদের দেশে শ্রমজীবী মানুষের যাবতীয় অধিকার কেড়ে নিতে চায় কর্পোরেটরা। মোদী সরকার কর্পোরেটদের সেই লালসাকেই পূরণ করতে চায়— তাই নয়া শ্রম আইন।

শ্রম সম্পর্ক বিষয়ক প্রচলিত তিনটি আইনকে বাতিল করে একটি আইন প্রণয়নের আসল উদ্দেশ্য আরও অনেক বেশি রাজনৈতিক। নয়া আইনে সরকার “ফিক্সড টার্ম এম্পলয়মেন্ট” মানে চুক্তি ভিত্তিক নির্দিষ্ট সময়ের কাজে নিয়োগকে বৈধতা দিয়েছে। এর ফলে যে কোনও কাজে স্থায়ী কর্মী নিয়োগ করার প্রয়োজন নেই বলে দেখানো যাবে, আবার নির্দিষ্ট সময় অন্তর নিযুক্ত শ্রমিককে বদলে দিয়ে কিংবা বারে বারে একই লোককে নিয়োগ করে খালি পদ নেই দেখিয়ে দেওয়া যাবে। অর্থাৎ সারা দেশে কোটি কোটি বেকারদের কাজের ন্যায্য দাবীকে সহজেই নস্যাৎ করতে চাইছে সরকার। এর সাথে অস্থায়ী কর্মচারী, মজদুরদের কাজ হারানোর ভয় দেখিয়ে কোনোরকম ন্যায্য দাবী, অধিকার থেকেও সরিয়ে রাখা সহজ হবে। নিস্কন্টক মুনাফার লক্ষ্যে কর্পোরেটরা তাই চায়, মোদী সরকার সেই ক্ষেত্র প্রস্তুত করে দিচ্ছে।

মনে রাখতে হবে চুক্তি ভিত্তিক নির্দিষ্ট সময়ের কাজে নিয়োগকে আইনি বৈধতা দেবার বিষয়টি হঠাৎ করে বিজেপি’র মাথায় আসেনি, ২০০৩ সালে অটল বিহারী বাজপেয়ির নেতৃত্বে এন ডি এ সরকার প্রথম এমন আইনের প্রস্তাব করেছিল। এতদিন উৎপাদন কিংবা পরিষেবা মূলক যে কোনও সংস্থায় একশো জনের বেশি শ্রমিক-কর্মচারী থাকলে তাকে শিল্পসংস্থা হিসাবে চিহ্নিত করা হত, এবং সেই অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট আইন সমূহ প্রযোজ্য হত। যাতে আরও বেশি সংখ্যায় শ্রমিক-কর্মচারী শ্রমিক অধিকার আইনের সুবিধা পেতে পারেন তাই কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নগুলির দাবী ছিল শিল্পসংস্থায় ন্যুনতম শ্রমিক সংখ্যা ৫০ করার দাবী জানিয়েছিল।

মোদী সরকারের যুক্তি ১০০ জন শ্রমিক থাকার আইনের কারনেই নাকি ছোট সংস্থাগুলি বড় হতে পারছেনা! এই অজুহাতে নয়া আইনে শিল্পসংস্থা হতে গেলে ন্যুনতম শ্রমিক-কর্মচারীদের সংখ্যা একধাক্কায় ৩০০ করে দেওয়া হয়েছে! এতে কি হল! আগে যা ছিল তার চেয়েও কম শ্রমিক এখন শ্রমিক অধিকার আইনের সুযোগসুবিধা পাবেন, বাকিরা সকলেই বঞ্চিত হবেন।

নয়া আইনে সংগঠিত ক্ষেত্রে ট্রেড ইউনিয়নে কর্মকর্তাদের মোট সংখ্যার একের তিনভাগ অথবা ৫ জনকে (যেটি সংখ্যায় কম হবে) সংস্থায় কর্মরত হতে হবে— এর উদ্দেশ্য কি? ট্রেড ইউনিয়নের অনেক গুরুত্বপূর্ণ পদে সর্বক্ষণের সংগঠকরা কাজ করেন, মালিকরা এদের ভয় দেখিয়ে ভুল অথবা অন্যায় কোনও সিদ্ধান্ত মেনে নিতে বাধ্য করতে পারে না। সারা দেশের ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনে এইসব সর্বক্ষণের সংগঠকরা অনেক ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছেন। এদের সংখ্যা কমাতেই এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। অসংগঠিত ক্ষেত্রে ট্রেড ইউনিয়নের ৫০ শতাংশ কর্মীকে বাইরে থেকে নেওয়ার নিদান রয়েছে। ট্রেড ইউনিয়নের স্বীকৃতি সংক্রান্ত প্রক্রিয়ায় এতদিন অবধি গণতান্ত্রিক প্রকরণ হিসাবে শ্রমিকদের ভোটদানের সময় গোপন ব্যালটের ব্যবস্থা ছিল, এখন তা তুলে দেওয়া হল। ৫১ শতাংশ শ্রমিকদের সমর্থন আছে এমন ট্রেড ইউনিয়নকেই স্বীকৃতি দেবে সরকার – অথচ সেই প্রক্রিয়ায় গোপন ব্যালটে ভোট দেওয়া যাবে না! মালিকপক্ষের বিরুদ্ধে নালিশ জানানোর সময়সীমা পূর্বে ছিল ৩ বছর, এখন করা হয়েছে ২ বছর! লেবর কোর্ট বাতিল হয়েছে, কোনও সমস্যায় মীমাংসা না হলে তাকে ইন্ডাস্ট্রিয়াল ট্রাইব্যুনালে পাঠানোর বন্দোবস্ত ছিল আগের আইনে— নয়া আইনে সরকারের সেই বাধ্যবাধকতা থাকছে না। এমনকি যে সমস্ত মামলা ট্রাইব্যুনালে চলছে সেগুলির ক্ষেত্রে কার্যক্রম শেষ হবার ৬০ দিন পরে ধর্মঘটের সুযোগ রয়েছে। শ্রম দপ্তরে আলোচনা চলছে এমন সংস্থার ক্ষেত্রে আলোচনা শেষ হবার ৭ দিনের আগে ধর্মঘট করা যাবে না। এছাড়াও ন্যুনতম শ্রমিক সংখ্যার অজুহাতে শিল্পসংস্থা হিসাবে সরকার যে সংস্থাকে চিহ্নিত করতেই রাজি নয় সেখানেও ধর্মঘট করতে গেলে ৬২(১)(এ) ধারা অনুযায়ী ৬০ দিন আগে আবার ৬২(২) ধারায় ১৪ দিন আগে আগাম নোটিশ দেওয়া নয়া আইনের বলে বাধ্যতামূলক।

এসবই হল ঘুরপথে শ্রমজীবী মানুষকে শোষণ করার পুরানো সমস্ত পন্থাকে নতুন আইনের নামে ফিরিয়ে আনা। মোদী সরকার সেই কাজে নিজেদের শ্রেণী চরিত্র স্পষ্ট করছে। লড়াই আন্দোলন সংগ্রামের রাস্তাতেই অর্জিত অধিকার রক্ষার লড়াইতে সমবেত হতে হবে ভারতের শ্রমজীবী মানুষকে, পাশে নিতে হবে মেহনতি জনগণের বৃহত্তর অংশকে।

কয়েকটি বুনিয়াদি সত্য আমাদের বারে বারে স্মরণে রাখতে হবে। ‘পুঁজি হচ্ছে মৃত শ্রম’। পুঁজিবাদ চিরকাল ব্যবহার করে মৃত শ্রমকে।

Spread the word

Leave a Reply