“The Bible shows the way to go to heaven, not the way the heavens go” – A Memoir To Galileo Galilei

ওয়েবডেস্ক প্রতিবেদন

পিতার ইচ্ছায় চিকিৎসাবিদ্যার শিক্ষার্থী হিসেবে পিসার কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন। কিন্তু ফলিত দর্শন এবং গণিতের প্রতি তার আকর্ষণ ক্রমশ বেড়েই চলে। ইতালির ফ্লোরেন্স শহরের এক সাধারণ পরিবারে তার জন্ম, আজকের দিনে – ১৫ই ফেব্রুয়ারি ১৫৬৪। নাম গ্যালিলিও গ্যালিলি।

গ্যালিলিও গ্যালিলি

চিকিৎসক হতে চান না, শেষে রাজি করাতে পেরেছিলেন পিতা ভিনশেনজো গ্যালিলি’কে। পিসায় থাকাকালীন গণিতের বিখ্যাত শিক্ষক ফিলিপ্পো ফ্যান্তনির চোখে পড়ে গ্যালিলিওর অধ্যাবসায়। সঠিক প্রতিভা চিনতে ভুল করেননি ফিলিপ। প্রথা সম্মত পথে গ্যালিলিওর গণিত শিক্ষা শুরু হয়।

প্রথমে ফ্লোরেন্স, পরে ভ্যাল্লোমব্রসায় গণিত শিক্ষকতার কাজ শুরু করেন। তখনকার সময়ে কোন বস্তুর ভরকেন্দ্র নির্ণয় গণিতের জগতের এক অন্যতম প্রধান আলোচনার বিষয়। ১৫৮৯ সালে পিসা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগের প্রধানের পদ খালি হলে গ্যালিলিও সেই পদে নিযুক্ত হন, ফ্লোরেন্সে শিক্ষক হিসেবে ততদিনে ইতালির সর্বত্র তার সুনাম ছড়িয়ে পড়েছে। ১৫৯১ সালে পিতার মৃত্যুর পরে পরিবারের ভরণ পোষণের দায়িত্ব প্রথম সন্তান হিসেবে গ্যালিলিওর উপরে পড়ে। ১৫৯২ সালে পাদুয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে নিযুক্ত হবার পরে আর্থিক অনটন কিছুটা মেটে।

১৫৯৮ সালে জোহান্স কেপলার কে লেখা একটি ব্যক্তিগত চিঠিতে নিজেকে কোপার্নিকান ( কোপার্নিকাসের মতের সমর্থক) বলে উল্লেখ করেন। ইতিমধ্যেই অবাধে পতনশীল / চলনশীল বস্তুর গতি সংক্রান্ত গবেষণায় তিনি অনেকটা দূর এগিয়ে গেছেন। ১৬০৯ সালে গ্যালিলিও কাছে একটি চিঠি এসে পৌঁছায় – তাতে লেখা ছিল এক ডেনমার্কবাসী এমন একটি যন্ত্র নির্মাণ করেছে যার দ্বারা অনেক দূরে বস্তুকে স্পষ্ট দেখা যায়। গ্যালিলিওকে এই খবর ভীষণ উৎসাহ দেয়, নিজের চেষ্টাতেই বানিয়ে ফেলেন একই ধরনের একটি যন্ত্র যাকে আজ আমরা দূরবীন বলে জানি – গ্যালিলিও নাম রেখেছিলেন Perspicillum। এই যন্ত্রের কার্যক্ষমতা অসাধারণ ছিল, নৌসেনা এবং অন্যান্য কাজে এর ব্যবহারের অপরিহার্যতা সম্পর্কে নিশ্চিত ছিলেন গ্যালিলিও। কখনো নিজেকে এই যন্ত্রের আবিষ্কর্তা বলে দাবি করেন নি। সর্বদা স্বীকার করতেন চিঠিতে পাওয়া সেই ডেনমার্কবাসীর অবদানের কথা।

এই বছরের শেষের দিকে নিজের তৈরি সেই দূরবীনকে এক রাতের আকাশের দিকে ঘুরিয়ে দেন গ্যালিলিও। বিজ্ঞানের ইতিহাসে এই মুহূর্ত চিরস্মরণীয়। তিনি চাঁদের মাটিতে পাহাড়ের মতো ভূমিরূপ দেখেন। রাতের আঁধার চিরে সেই দূরবীনে দেখা সিত্র সেদিন স্পষ্ট না হলেও গ্যালিলিওকে এক বিরাট দ্বিধার মধ্যে ফেলে দেয়। এই দ্বিধায় তাকে চিন্তা করতে বাধ্য করে সত্যিই কেতাবে যা লেখা রয়েছে ( তখন সৌরজগৎ এবং প্রকৃতির নিয়ম সম্পর্কে বাইবেল না হলে অ্যারিস্টটলের কথাকেই প্রামাণ্য ধরা হতো ) চোখে তেমনটা দেখা যাচ্ছে না। চোখে যা দেখা যাচ্ছে তা যদি সত্যি হয় তবে কেতাবের লেখা অভ্রান্ত নয়, তার সংশোধন প্রয়োজন! এখান থেকেই গ্যালিলিওর জীবনের মোড় ঘুরে যায় একজন সাধারন বিজ্ঞানী থেকে এক ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্বে।

গ্যালিলিওর দূরবীন
গ্যালিলিওর দূরবীন

সেদিনের পর থেকে বহু রাতব্যাপী গবেষণায় তিনি আবিষ্কার করলেন পৃথিবীকে কেন্দ্র করে আদৌ সৌরজগৎ ঘুরছে না, বরং উল্টোটাই সত্যি! নিজের আবিষ্কৃত দূরবীনে ভেনাস গ্রহের বিভিন্ন দশা (চাঁদের নেয় এক এক সময় এক এক চেহারা) পর্যবেক্ষণ করে গ্যালিলিও নিশ্চিত হলেন সূর্যের চারদিকে প্রদক্ষিণ না করলে এমন হতে পারে না। এর আগে প্রথমে টাইকো ব্রাহে বলেছিলেন পৃথিবী ছাড়া অন্যান্য সকল গ্রহ সূর্যকে প্রদক্ষিণ করে, কোপার্নিকাস বললেন পৃথিবীর সব গ্রহের চলনই সূর্যকে কেন্দ্রে রেখে পর্যাবৃত্ত। গ্যালিলিও বুঝতে পারেন তার আবিষ্কার, গবেষণা সবটাই কোপার্নিকাসের মতকে সমর্থন করছে।

সেই যুগে আবর্তনশীল পৃথিবীর যারা বিরোধিতা করতেন তাদের যুক্তি ছিল একটি উঁচু স্থান থেকে কোন বস্তুকে বিনা বাধায় নিচে পড়তে দেওয়া হলে সেই বস্তু যেহেতু অনুষ্ঠানটির পিছনে এসে পড়ে না, অতএব পৃথিবী ঘুরছে না। গ্যালিলিও নিজের উদ্যোগে হাতে-কলমে এই যুক্তির বিপক্ষে উপযুক্ত পরীক্ষা সম্পন্ন করে এবং গাণিতিক হিসাব করে দেখেন ফলাফল প্রমাণ করছে পৃথিবী আবর্তনশীল! এরপরে ১৬১২ সাল নাগাদ তিনি সৌরকলঙ্কের সম্ভাবনার দাবি করেন, এবং ১৬১৩ সালে দূরবীন এর সাহায্যে সৌরকলঙ্কের সন্ধান পান। এই ঘটনায় নিজের বক্তব্যের সমর্থনে আরো জোরালো প্রমাণ হাজির করেন তিনি। চার্চের কুনজর পড়তে শুরু করে তার উপরে।

শুরুতে নিজের আবিষ্কার এবং মতামত সম্পর্কে জনসাধারণের কাছে মুখ না খুললেও ধীরে ধীরে বিজ্ঞানীমহলে অ্যারিস্টটলের মতামতকে আক্রমণ করতে শুরু করেন গ্যালিলিও। ১৬১৬ – গ্র্যান্ড ডাচেস কে একটি চিঠিতে তিনি লেখেন ” আমি ঘোষণা করতে বাধ্য হচ্ছি সূর্যকে কেন্দ্র করেই অন্যান্য গ্রহের পরিচলন হয়, সূর্য নিজের কেন্দ্রীয় অবস্থান বদলায় না … এর ফলে অ্যারিস্টটল, টলেমি এবং ওই ধরনের যাবতীয় মতামত ভ্রান্ত হিসেবে গণ্য হবে” । ১৬২৩ সালে সৌরজগৎ সম্পর্কে নিজের প্রকাশিত বইতে লেখেন ” … এই কেতাবে মহাবিশ্বের ব্যাখ্যা রয়েছে, কিন্তু তা বুঝতে গেলে একটি নির্দিষ্ট ভাষায় পারদর্শী হতে হয় – সেই ভাষা হল গণিত। গণিতের সঠিক উপলব্ধি ব্যতীত পাঠক অন্ধকারের কবলে নিজেকে হারিয়ে ফেলবেন”।

১৬৩২ সালে প্রকাশিত হয় আরেকটি বই ” ডায়ালগ কন্সার্নিং টু চিফ সিস্টেমস অফ দ্য ওয়ার্ল্ড ” – যাতে মহাবিশ্বের কাঠামো সম্পর্কে দুটি প্রতিদ্বন্দ্বী ধারণার বিভিন্ন যুক্তি – প্রতি যুক্তির ভিত্তিতে তিনি প্রমাণ করেন টলেমিয় এবং কোপার্নিকাসের মতের যুদ্ধে কোপার্নিকাসই সঠিক।

এই বই প্রকাশ হতে না হতেই নিষিদ্ধ ঘোষণা হয় এবং অবিলম্বে গ্যালিলিওকে রোমে ডেকে পাঠানো হয়।

অপরাধ? শাস্ত্রবাক্য সম্পর্কে সন্দেহ প্রকাশ এবং তাকে অমান্য করে জনমানসে বিজ্ঞানের প্রচার চালানো।

ধর্মবেত্তাদের সভায় বিচার শুরু হয় গ্যালিলিওর, বিজ্ঞানের।

বিচারে আজীবন কারাবাস এর শাস্তি দেওয়া হয়।

নিজের কারাজীবন, সন্তানের মৃত্যু – গ্যালিলিওকে দুমড়ে-মুচড়ে দিলেও ঐ অবস্থাতেই ৬ বছর গবেষণা করে লিখে ফেলেন ” ডিসকোর্সেস অ্যান্ড ম্যাথমেটিক্যাল ডেমোনস্ট্রেশনস কন্সার্নিং দ্য টু নিউ সায়েন্সেস ” – এই বই গোপনে ইতালির বাইরে এনে প্রচার করা হয়েছিল।

চার্চের অধীনস্ত বিদ্যালয়ের ছাত্রাবস্থায় এক ঝড়ের সন্ধ্যায় হাওয়ায় দুলতে থাকা লণ্ঠনের দুলুনির সময় মাপতে নিজের হাতের নাড়ি টিপে পরীক্ষা করেছিলেন গ্যালিলিও, বিস্ময়ের সাথে পর্যবেক্ষণ করেছিলেন লণ্ঠনের দুলুনির সময় দুদিকে যেতে আসতে একই সময় লাগে।

১৬৪০ সালে গ্যালিলিও একটি পেন্ডুলাম ঘড়ির নকশা প্রস্তুত করেন।

১৬৪২ সালে গ্যালিলিও গ্যালিলির মৃত্যু হয়।

এই প্রবন্ধে গ্যালিলিওর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারী প্রবল শক্তিধর ব্যক্তিবর্গের নাম সমুহ উপেক্ষা করা হয়েছে। এর কারণ আজকের পৃথিবী তাদের কাউকেই মনে রাখেনি, মনে রেখেছে সেই বিজ্ঞানীকে যার দেখার যন্ত্র গোটা পৃথিবীর চোখ খুলে দিয়েছিল। বিজ্ঞানের কাজই তাই।

ওয়েবডেস্কের পক্ষেঃ সৌভিক ঘোষ

Spread the word

Leave a Reply