স্মৃতিতে উজ্জ্বল – চির অম্লান – কনক মুখার্জী : মিনতি ঘোষ….

৩০ ডিসেম্বর ২০২১ , বৃহস্পতিবার


একশো বছর আগে অবিভক্ত বাংলার যশোহর জেলার অখ্যাত “বেন্দা ” গ্রামে এক শিশুকন্যা জন্মেছিলেন। নাম – কনকলতা দাশগুপ্ত। পিতা প্রখ্যাত আইনজীবী ধিতিশচন্দ্র দাশগুপ্ত। মাতা – মালিনী দেবী। ১৯৪২ সালে কমিউনিস্ট নেতা সরোজ মুখোপাধ্যায়ের সাথে রেজিষ্ট্রি করে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে যিনি হয়েছিলেন কনক মুখোপাধ্যায়। তিনি কমিউনিস্ট নেত্রী। পশ্চিমবঙ্গের আগেও যুক্ত বাংলার মহিলা আন্দোলনের পথ প্রদর্শকদের অন্যতম। পরবর্তীতে সারা ভারত গণতান্ত্রিক মহিলা সমিতির জন্ম লগ্ন থেকে সর্বভারতীয় নেত্রী। ছাত্রী জীবনে স্কুলের ম্যাগাজিনে তার প্রথম কবিতা প্রকাশ। রাজনীতির পাশাপাশি তিনি আজীবন সাহিত্য সাধনায় ব্রতী ছিলেন। কবিতা, গল্প, উপন্যাস, প্রবন্ধ, অনুবাদ সাহিত্য যা নারী আন্দোলনের পাশাপশি সাহিত্য সংস্কৃতি জগতে উজ্জ্বলতায় উদ্ভাসিত। সাধুরা সাধনা করেন নাকি ঈশ্বর প্রাপ্তির লক্ষ্যে, স্বর্গ নামক অলীক কল্পনার জগতে ‘ মৃত্যুর পর ভালো থাকার জন্য ‘। কনক মুখোপাধ্যায়ের সাধনা মানবমুক্তির লক্ষ্যে। যে মানুষের অর্ধেক অংশ মানবী।

সরোজ মুখোপাধ্যায়


তাঁর জন্মশতবর্ষ এর শেষ লগ্নে ফিরে দেখি তিনি সেই নারী যিনি অষ্টম শ্রেণীতে পড়ার সময় থেকেই বিশিষ্ট কমিউনিস্ট নেতা কৃষ্ণ বিনোদ রায়, সুকুমার মিত্র, শান্তিময় ঘোষ প্রমুখের সান্নিধ্যে এসে কমিউনিস্ট পার্টির প্রতি আকৃষ্ট হন। মতাদর্শের প্রতি আজীবন দায়বদ্ধ থেকে সমগ্র মানব সমাজ বিশেষ করে নারীদের সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক লড়াইয়ের পাশে থেকেছেন। নেতৃত্ব দিয়েছেন। উদ্বুদ্ধ করেছেন অগণিত ‘ শিক্ষিত ও অশিক্ষিত ‘ মেয়ে দের জীবন সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে যেতে। পরিবেশ, পরিবার, পারিপার্শ্বিকতা একজন মানুষের গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে সহায়ক ভুমিকা পালন করে থাকে। কনক দাশগুপ্ত বৈদ্য পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। যে সময়ে ব্রাহ্মণ, বৈদ্য, কায়স্থ প্রমুখ উচ্চ বর্ণের মধ্যে ঊনবিংশ শতকের নব জাগরণের আলো পৌঁছেছিল। সেইসাথে দাদা, পাড়ার দাদাদের ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ, বালিকা কনকের মাধ্যমে গোপন চিঠি পাঠানো তাঁর চিন্তাজগতে ছাপ ফেলেছিল। গ্রামের প্রাকৃতিক পরিবেশ, বয়ে যাওয়া কালিগঙ্গা নদী, গ্রামের শেষপ্রান্তে অবস্থিত নমশূদ্র পাড়ায় বাধাহীন যাওয়া – আসা তাঁর শিশু মনের বিকাশে অন্য মাত্রা যোগ করেছিল।
মেধাবী ছাত্রী কনক বৃত্তি পেয়ে পঞ্চম শ্রেণীতে উঠলেন। কিছুটা বাধা অতিক্রম করেই শহরে পিতার দ্বিতীয় সংসারে পৌঁছে আরো বাধা পেরিয়ে স্কুলে ভর্তি হলেন। এখানেই লক্ষ্যনীয় তার অদম্য জেদ। লক্ষ্যে র প্রতি অবিচল নিষ্ঠা তাঁকে এমন এক উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছে যে শতবর্ষ পার হয়ে গেলেও সশ্রদ্ধ স্মরণ করছি, চর্চা করছি। আগামী প্রজন্ম হয়ত তাঁকে নিয়ে গবেষণায় ব্রতী হবেন।


স্কুলে খেলাধুলা, কবিতা লেখা, নাটক করা চলতে থাকা র পাশাপাশি চারিদিকের রাজনৈতিক হাওয়া তাঁর নজর এড়ায়নি। এই সময়েই তাঁর হাতে এসে গেল একটি ছোট পুস্তিকা। কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো। রাত জেগে সবার অলক্ষ্যে পড়লেন। তাঁর কাছে যা ছিল পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ কবিতা – মহাকাব্য। ১৯৩৭ সালে প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পাশ করার পর তাঁরই স্কুলের শিক্ষক প্রমথবাবুর সহায়তায় বাধার পাহাড় অতিক্রম করে মেডিক্যাল পড়ার সুযোগ পেয়েও রাজনীতি করার তাড়নায় ভর্তি হলেন বেথুন কলেজে। কনকদি ‘ র ভাষায় ” পেরিয়ে এলাম বদ্ধ ঘরের চৌকাঠ ” –
১৯৩৮ সালে তিনি কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ অর্জন করেন। এ বছরই ছাত্র ফেডারেশনের সাথে যুক্ত গার্লস স্টুডেন্টস এসোসিয়েশনের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক নিযুক্ত হলেন। ১৯৩৯ সালে লখনৌ তে অল ইন্ডিয়া গার্লস স্টুডেন্টস কনফারেন্সে যোগ দেন। সমাজে নারী পুরুষের বৈষম্য, বিবাহ, বিবাহ বিচ্ছেদের প্রভৃতি ক্ষেত্রে নারীদের অধিকারের উপরে যে প্রস্তাব নেওয়া হয়েছিল তার প্রস্তাবক ছিলেন তিনি। দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধ শুরু হয়েছে। লিফলেট বিলি করে গ্রেফতার হলেন। কিন্তু কাকাবাবুর নির্দেশে বন্ডে সই করেন নি। শুরু হল তাঁর অন্য জীবন। একদিকে সেল, অন্যদিকে কলকাতা, হাওড়া, হুগলি জেলায় প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা। কাকাবাবুর নির্দেশে বরিশালে চলে যাওয়া। কলেজে ভর্তি হলেও আবার চলে যাওয়া। প্রাইভেটে বি এ, এম এ পাশ করলেন তিনি।
অসাধারণ মেধা, অংকে পারদর্শী, তিনি ছিলেন অগাধ পাণ্ডিত্যের অধিকারিণী। ব্রিটিশ সরকার বারবার কমিউনিস্ট পার্টিকে নিষিদ্ধ করেছে। অপরিসীম দুঃখ কষ্ট সহ্য করে তখন পার্টি করতে হয়েছে। ১৯৪৭ সালে দেশ স্বাধীন হয়েছে। কমিউনিস্ট পার্টি আবার হয়েছে নিষিদ্ধ। দমিয়ে রাখা যায়নি কমিউনিস্টদের। গ্রামে গ্রামে ছড়িয়ে পড়লো তেভাগার আন্দোলন, চটকল শ্রমিকদের আন্দোলন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পূর্বেই গড়ে উঠেছে বিভিন্ন গণসংগঠন। ১৯৪৩ এ মন্বন্তর – গঠিত হল নিখিলবঙ্গ মহিলা আত্মরক্ষা সমিতি। ফ্যাসিবিরোধি – সাম্রাজ্যবাদবিরোধী ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের লক্ষ্যে যে সমিতি গড়ে উঠল পরবর্তীতে আদর্শগত কারণে তা আর এক থাকলো না। ১৯৭০ সালের ৭ই মার্চ গড়ে ওঠে পশ্চিমবঙ্গ গণতান্ত্রিক মহিলা সমিতি। মতাদর্শগত দ্বন্দ্ব – সংঘাতের মধ্যে দিয়েই সমিতির মুখপত্র ‘ ঘরে বাইরে ‘ থেকে সরে এসে মহিলাদের রাজনৈতিক – সাংস্কৃতিক পত্রিকা ‘ একসাথে ‘ প্রকাশ হয় ১৯৬৮ সালের মে মাসে। আজীবন সম্পাদিকা তিনি। প্রথম সম্পাদকীয় তে লিখেছেন – ” একসাথের কথা “। একসাথে মহিলা পত্রিকা। শ্রেণী সমাজে বৈষম্যের শিকার, বঞ্চিত মেয়েদের মুখপত্র। তাদেরই আত্মপ্রকাশের ও মুক্তি অভিযানের পথের বিশেষ প্রয়োজনে এই পত্রিকার প্রকাশ শুরু হল। “
এই একসাথে পত্রিকা ভারতবর্ষের মহিলা লেখিকা সৃষ্টির অন্যতম সূতিকাগার।
কাঁটা বিছানো পথেই তিনি বিপ্লবের লক্ষ্যে অগ্রসর হয়েছেন। পার্টির অভ্যন্তরে সংশোধন বাদ – সংকীর্ণ তা বাদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন। তিনি বারে বারে জেল খেটেছেন। জেলার জীবন কখনো স্বল্পমেয়াদী, কখনো দীর্ঘ মেয়াদী। ৪০ দিন অনশন করেছেন। ১৯৬২ সালে ভারত রক্ষা আইনে সহযোদ্ধা আমাদের নেতা সরোজ মুখার্জী ও কনক দি একসাথে জেলে। একমাত্র পুত্র ও গোটা পার্টি পরিবারের কাছে থেকেছে। জেলে বসে তিনি লিখেছেন ” বন্দী ফাল্গুন ” উপন্যাসটি। শুধুমাত্র আদর্শের প্রতি নিষ্ঠার কারণেই যে কাজে যুক্ত হয়েছে ন সেখানেই কৃতিত্বের সাক্ষর রেখেছেন। সি পি আই ( এম ) রাজ্য ও কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হন অথবা যুক্তফ্রন্টের সময় কর্পোরেশনের “অন্ডার ম্যাথ “, অথবা রাজ্য সভার সাংসদ প্রতিটি ক্ষেত্রে তিনি সফল। বাংলা, হিন্দী, ইংরেজি ভাষায় ওজস্বিনী বক্তৃতা দিয়েছেন। দেশে বিদেশে তিনি সমাদৃতা। একজন কমিউনিস্ট নেত্রী হিসাবে অনাবিল স্নেহ, পরিবারের প্রতি কর্তব্য , বন্ধুদের স্মরণে রাখা, কলেজে ছাত্র পড়ানো, দ্বিতীয় সন্তান সম ‘ একসাথে ‘ পত্রিকা পরিচালনা কি অনায়াসে করতে পেরেছেন।

Third AIDWA Conference in West Bengal, 9-12 October 1990. Kanak Mujherjee is standing second from the right in the front row, in white, with other participants of the conference.

জন্মশতবর্ষ এ তাঁকে জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা।
স্বাধীনতার ৭৫ বছর উদযাপনের বছরে দাঁড়িয়ে আজ রাষ্ট্রীয় স্তর থেকে পশ্চাৎপদ চিন্তা, ধর্মান্ধতা, ঘৃণা, বিভাজনের যে উৎকট আয়োজন চলছে তার বিরুদ্ধে সুদৃঢ় প্রতিরোধ গড়ে তুলতে দেশের সংবিধান, গণতন্ত্র এবং ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্রকে অক্ষুন্ন রাখার দীর্ঘস্থায়ী সংগ্রামে কমরেড কনক মুখোপাধ্যায়ের জীবন ও কর্মকাণ্ড আমাদের আলোর দিশা হয়ে চলবে। কারণ আজও আমরা রাস্তায়।

Spread the word

Leave a Reply