From College Street to College Gate

আকাশ কর

ফুটবল জ্বরে কাঁপছে গোটা বিশ্ব। মেসি, নেইমার, রোনাল্ডোরা তো আছেই – আরও নতুন কত তারা পৃথিবীর মাটিতে পরিচিত হবেন এই দুই মাসে। ১৮ ডিসেম্বরের রাতে শেষ অবধি সঠিক নিশানায় লাথি মেরে যারা বল পৌঁছাবে বিশ্বজয়ী হিসেবে পরিচিত হবে তারাই। কাদের হাতে উঠবে সেই শিরোপা তা নিয়েই এত আয়োজন এত তর্ক! অথচ ১২ বছর আগে এমনই এক ডিসেম্বরের ২০ তারিখে সঠিক নিশানায় লাথি মেরেই আন্দুল কলজের ছাত্র স্বপন কোলের দেহটা লাশকাটা ঘরে পৌঁছে দিয়েছিল টিএমসিপি। এসএফআই করার অপরাধে। ইট, লোহার রড দিয়ে থেঁতলে খুন করার পর আক্ষরিক অর্থেই স্বপনের দেহটাকে নিয়ে লাথালাথি করছিল ওরা। সেটা ২০১০ সাল! তারিখটা মাথায় রাখা দরকার। শিক্ষাক্ষেত্রে তৃণমূলী মাতব্বরি নিয়ে কথা বলার সময়ে যারা নিয়ম করে দু-ফোঁটা বাম আমল মিশিয়ে নিরাপদ থাকার চেষ্টা করেন, তাদের আরেকবার মনে করিয়ে দেওয়া দরকার।


২০১০ এর পর ২০১১। ষোলকলা পূর্ণ হল। বাঙালীর অভ্যেস যে কোনও শুভ কাজ নারকেল ফাটিয়ে শুরু করার। আরাবুলও তা-ই করলেন। অধ্যাপিকার মাথায় জগ ফাটিয়ে শুরু হল দুর্বৃত্তায়ন। রায়গঞ্জ – মাজদিয়া কলেজে ঝোড়ো ওপেনিং ব্যাটিং করল তৃণমূল। সব কলেজ থেকে এসএফআই সহ সমস্ত বিরোধী স্বরকে মুছে দিয়ে মুখভরা দাড়িতে গুলিয়ে ফেলে মার্কস ভেবে রবীন্দ্রনাথের ছবি ভাঙল মত্তহস্তীর দল। ছাত্রছাত্রীদের মত নেওয়ার কি আছে! ভোট-ফোট বন্ধ। ইউনিয়ন দিদির-ভাইদের পৈত্রিক সম্পত্তি। এসবের প্রতিবাদ করে ঝরে গেল সুদীপ্ত। একা বসে বেহালা বাজাত ওর নিঃসঙ্গ বাবা। রাজ্য থেকে লোকাল এসএফআই অফিসে তখন বেহালারই সুর সর্বত্র। রোজই খবর হয় হাত ভাঙার নয় মাথা ফাটার আর নাহলে কিছু না করেই জেলে যাওয়ার। ঝড়ের মুখে বালিতে মুখ চেপে কোনওভাবে টিকে থাকার সংগ্রাম।


কাট টু ২০২২।


এর মধ্যে গঙ্গা দিয়ে থুড়ি টেমস দিয়ে গড়িয়েছে অনেক জল। ভুলক্রমে যাদবপুর আর প্রেসিডেন্সিতে ভোট করে লাল আবীরের ফোয়ারা দেখে আর ছাত্রভোটের নাম আর মুখে আনেনি তৃণমূল সরকার। এরই মধ্যে কলেজে কলেজে অনার্স বিক্রির নয়া শিল্প আবিষ্কার করেও অর্থনীতিতে নোবেল না পাওয়ার দুঃখে বিজেপিমুখী হয়েছেন তৃণমূলী শঙ্কু! শিক্ষার প্রগতি, দেশপ্রেম আর সঙ্গবদ্ধ জীবনের নামে অবাধ দুর্নীতি, মস্তানি আর ফুর্তির আখড়া হয়ে উঠল রাজ্যের শিক্ষাক্ষেত্র। অন্যদিকে নীরবে নিভৃতে দাঁতে দাঁত চেপে এই সময়ে নিজেদের সংগঠিত করার কাজ করে গিয়েছে ভারতের ছাত্র ফেডারেশন। নানা ফর্মে নানা শেপে ছাত্রছাত্রীদের এক জায়গায় করে গন্তব্য ফের ক্যাম্পাস। রাজধানীর রেডিয়াসে অল্প কয়েক কিলোমিটার নয় রাজ্য জুড়ে প্রান্তিকে প্রান্তিকে। ২০১৯-২০ সাল থেকে ধারাবাহিকভাবে সময় সুযোগ মত রাজ্যের বিভিন্ন কলেজে পৌঁছানোর চেষ্টা করেছে এসএফআই। কখনও পেরেছে কখনও পুরোটা পারেনি। টিএমসিপির অভিধানে এতদিন ছিল শুধুই তাড়া করা। অভিধান খুলতে হয়নি এবার মাঝেমধ্যে নিজেরাই বুঝেছে তাড়া খাওয়ার মানে। দীর্ঘদিনের শূন্যস্থান, অনভ্যেস, সন্ত্রাসের স্মৃতি পেরিয়ে আজ আবার কলেজের দিকে এগোচ্ছে সেদিনের রেড ভলেন্টিয়াররা। কারণ মানুষের কাজ মানে শুধু পরিষেবা দেওয়া নয়। বরং, তাদের এককাট্টা করে প্রাপ্যটুকু আদায় করে নেওয়া।

জাতীয় শিক্ষানীতির নামে যা যা করছে কেন্দ্রের সরকার, একই কাজ তৃণমূলসুলভ মোটা দাগে অনেক আগে থেকেই শুরু হয়েছে রাজ্যে। লেখাপড়ার খরচ কমানো, প্রাপ্য স্কলারশিপ, খোলামেলা পরিবেশ, বন্ধুত্ব সম্প্রীতির পক্ষে একজোট হচ্ছে ছেলেমেয়েরা। সঙ্গে চোখের সামনে স্বপ্নভঙ্গের অন্ধকার। কেউ খেটেও চাকরি পায়নি আর কেউ …! অনুব্রত’র মেয়ে তো টিকটকে নেচেই শিক্ষকতার বেতন পেলেন। রেগে আছে আঠারোর বারুদ। রোদে দেওয়ার কাজ করছে শ্বেতপতাকা। কলকাতা, দুই চব্বিশ পরগণা হাওড়া, হুগলির মত শহর ঘেষা জেলায় তো বটেই মেদিনীপুর, মুর্শিদাবাদ, কিংবা উত্তরবঙ্গের কোচবিহার আলিপুরদুয়ার একাধিক জেলায় একাধিক কলেজের গেটে এই বছরেই টিএমসিপির সাথে মুখোমুখি হয়েছে এসএফআই। কোথাও একতরফা মার খেয়ে ফিরে আসেনি। যে স্বপন কোলের শহীদ দিবস দিয়ে লেখা শুরু করলাম, গত বছরের সেই দিনে হুগলীর উত্তরপাড়া কলেজে স্বপন কোলেকে স্মরণ করতে যায় এসএফআই। ব্যাট নিয়ে আক্রমণ করে তৃণমূল। কিছুক্ষন পরই হঠাৎ দেখা গেল ব্যাটগুলো সব কিভাবে এসএফআই কর্মীদের হাতে। আর ওরা উলটো দিকে দৌড়াচ্ছে উইসেন বোল্টের মত। এরকম বীরগাঁথা লেখা হচ্ছে একেরপর এক ক্যাম্পাসে। ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটির করিডর থেকে বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের দরজা – বুঝেছে এসএফআই ফিরছে। জেনেছে, স্বাধীনতা গণতন্ত্র সমাজতন্ত্রের উত্তাপ।


কাজ এখনও অনেক বাকি। রাজ্যের সমস্ত কলেজকে দুষ্কৃতিমুক্ত করতে হবে। ফিরিয়ে আনতে হবে সকলের মতপ্রকাশের পরিসর। নাবালক থেকে নাগরিক হয়ে ওঠার কারখানা এই সব কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সমস্ত কিছুকে দেখার ঠান্ডা হাওয়া বইয়ে দিতে হবে। সব ভোট হলেও ছাত্র ভোট ওরা করছে না। কারণ ওরা জানে, ছাত্রভোট হওয়া মানে ‘তোমারে বধিবে যে, গোকুলে বাড়িছে সে!’ আর এসএফআই এর বেড়ে ওঠা মানে, এসএফআই এর ইউনিয়ন মানে গরীব ঘরের ছেলেটার মাথা উঁচু করে দাঁড়ানো। ফার্স্ট ইয়ারের থতমত মেয়েটার সিআর হিসেবে ব্যস্ত দিন। গাছতলায় গিটার আর কলেজ মাঠে ক্রিকেট। কমনরুমে টিটি আর দেওয়ালজোড়া পত্রিকা। ফুল ফোটবার মরসুম। ঘুমন্ত কিংবা জ্যন্ত কোনও দৈত্যেরই পছন্দ না। তাই ফুল ফোটাবার সংগ্রাম আর কখনও কখনও তার জন্য হুল ফোটাবার বদঅভ্যেস ছড়িয়ে যাক ক্যাম্পাসে ক্যাম্পাসে।


শেষ করি ছোট্ট একটা অভিজ্ঞতা দিয়ে। উত্তর চব্বিশ পরগণা জেলায় বিভিন্ন কলেজের সামনে নভেম্বর-ডিসেম্বর-জানুয়ারি জুড়ে ফের যাওয়ার কর্মসূচী নিয়েছে এসএফআই। বিভিন্ন দাবীতে সাক্ষর সংগ্রহ, সদস্যপদ, গেটসভা, ডেপুটেশন ইত্যাদির মাধ্যমে। কোনও কলেজে ৮-৯ বছর পর। কোথাও আবার ১২-১৩ বছর পরেও। এমনই একটা কর্মসূচীতে আমরা পৌঁছেছি বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী হিঙ্গলগঞ্জ কলেজে। ২০১৩ সালের পর প্রথমবার। সাক্ষর সংগ্রহ চলছে। ভেতরে টিএমসিপির জমায়েত। এসএফআই এর সাথে কাউকে কথা বলতে দেখলেই কার্যত হাত ধরে টেনে নিচ্ছে ভেতরে। ছাত্রছাত্রীদের চোখেও খানিকটা অবাক দৃষ্টি। এতদিন পর এসএফআই! মুখেচোখে ভয়ের ছাপও স্পষ্ট। এরইমধ্যে চার-পাঁচজন মেয়ে ঢুকছে কলেজে। দাঁড় করাল আমাদের কমরেডরা। সবটা শোনার পর সই করতে যাবে ওরা এমন সময় ভেতর থেকে আওয়াজ – “কর কর। সই কর। আজ আর জামাকাপড় পরে বাড়ি ফিরতে হবেনা।” পেনটা নামিয়ে মাথা নীচু করে কলেজে ঢুকে গেল ওরা। আমরা আরও কিছুক্ষন কর্মসূচী চালিয়ে মিছিল করে এলাম কলেজেরই অদূরে রাস্তার মোড়ে। সেখানে সভা হবে। সাথে ফের সাক্ষর সংগ্রহ। ঘন্টা তিনেক চলার পরে সভা তখন শেষের পথে। ফিরতি পথে সভার দিকেই আসছে সেই মেয়েগুলো। এবার সাথে আরও কয়েকন। সোজা রাস্তা ঘুরতেই চোখের আড়াল হল কলেজ। মুহূর্তে এদিক ওদিক দেখে হাত দিয়ে আমাদের কমরেডদের ডাকল ওরা। যেতেই, হাত থেকে সাক্ষর সংগ্রহের কাগজ আর পেনটা ছিনিয়ে নিয়ে খসখস করে সই করে দিল সবাই। তাড়াহুড়োয় যাওয়ার সময়ে ওদের একজন ফিসফিস করে বলে গেল, “কিছু মনে করো না। তখন সই করলে বাড়ি ফিরতে পারতাম না। তোমরা রোজ রোজ এসো। আমরা আছি …”


ব্যাস। এটুকুই। সেদিন থেকে মৃদুস্বরে বলা নরম গলার ঐ ‘আমরা আছি’টুকুই মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। অতটুকু কথা কিন্তু কত ওজন। অত নীচু স্বর অথচ কত দায়িত্ব দিয়ে গেল আমাদের কাঁধে। এবার আমাদের পালা। মগজে মতাদর্শ, বুকে সাহস আর অনেক অনেক ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে এবার এসএফআই কে কলেজে কলেজে গিয়ে সবাইকে বলতে হবে, “চিন্তা নেই। আমরাও আছি…”

Spread the word

Leave a Reply