বিকল্প ও উন্নতর ভাবনা – শুদ্ধস্বত্ব গুপ্ত…

পর্ব – ৭

দমবন্ধ জেল থেকে ভিন্নস্বরের অধিকার

একাত্তরে পশ্চিমবঙ্গে নির্বাচন। তার আগে দু’বার ভেঙে দেওয়া হয়েছে যুক্তফ্রন্ট সরকার। ১৯৬৭ এবং ১৯৬৯-এ। সরকার পরিচালিত হয়েছিল নির্দিষ্ট কর্মসূচীর ভিত্তিতে। অন্যতম প্রধান ছিল ক্ষমতার সীমাবদ্ধতার মধ্যে ভূমিসংস্কার। ১৯৭০’র ১৬ মার্চ পর্যন্ত টিকেছিল দ্বিতীয় যুক্তফ্রন্ট। সব মিলিয়ে বাইশ মাস টিকতে পেরেছিল দু’টি সরকার। কিন্তু গ্রামে কৃষিজীবি এবং শহরে শ্রমিকশ্রেণি, মধ্যবিত্তের মতো অংশগুলির অধিকারের লড়াইয়ে পাশে থাকল। চলতে থাকল খেটে খাওয়া সব অংশের গণতান্ত্রিক অধিকারের সংগ্রাম।


কেমন সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যুক্তফ্রন্ট সরকার? গণতান্ত্রিক আন্দোলন বা ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন পুলিশের হস্তক্ষেপে ভাঙা হবে না। ধর্মঘটের অধিকার থাকবে। উদ্ধার করা হবে বেনামি জমি। সরকারি সীমার বাইরে থাকা জমি প্রভাবশালীরা অন্য নামে লুকিয়ে রাখে। তেমন জমি উদ্ধার করা, সিলিংয়ের বাইরের জমি উদ্ধার করে সরকার খাস করল। বন্ধ হয়েছিল বর্গাদারদের উচ্ছেদ। স্লোগান উঠল- ‘বেনামি জমি দখল কর, দখলে রেখে চাষ কর’। রাজনৈতিক শক্তি যুক্তফ্রন্টে বামপন্থীদের বাইরেও বিভিন্ন অংশ ছিল।

সংবাদপত্রের একের পর এক প্রতিবেদন দেখাচ্ছে, ১৯৭০-এ যুক্তফ্রন্ট সরকার ভেঙে দেওয়ার পর চরম রাজনৈতিক অস্থিরতা রাজ্যে। তারপরও ১৯৭১ সালে বিধানসভা ভোটে সবচেয়ে বেশি আসন পেয়েছিল সিপিআই(এম)। রাজ্য ধর্মবীরা সেই দলকেই শপথ নিতে ডাকলেন না। ফের নির্বাচন বাহাত্তরে। নির্লজ্জ রিগিংয়ের হাত ধরে আসীন হলো সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের নেতৃত্বে কংগ্রেস সরকার। যে সরকার রবীন্দ্রনাথের গানেও নিষেধাজ্ঞা চাপাতে কসুর করেনি। ১৯৭৫-এ সারা দেশে জরুরি অবস্থা জারি হয়েছিল। মিসা, এসমার মতো কালাকানুন কেড়ে নিয়েছিল সব গণতান্ত্রিক অধিকার।

বামপন্থী আন্দোলনের নেতারা যদিও সেদিনের তুলনা টেনে বলছেন আজ দেশের পরিস্থিতি আরও ভয়ঙ্কর। বিরোধিতার ন্যূনতম সুর থাকলেই দেশদ্রোহিতার অভিযোগ দায়ের হচ্ছে। সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলার লক্ষ্য তৈরি হয়েছিল জাতীয় তদন্ত সংস্থা, এনআইএ। যখন-তখন এই কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থাকে গণতান্ত্রিক আন্দোলন ভাঙতে কাজে লাগাচ্ছে বিজেপি সরকার।

সত্তরের দশকে অতি বামপন্থার রাজনীতি এ রাজ্যে সঙ্কট গভীরতর করেছে। ‘শ্রেণিশত্রু খতমের’ ভুল লাইনের ফায়দা তুলে লেলিয়ে দেওয়া হয়েছে পুলিশ। গণতান্ত্রিক আন্দোলনের শ’য়ে শ’য়ে কর্মীর রক্তে ভেসেছে রাজ্য। পাড়ায় পাড়ায় ‘কম্বিং অপারেশন’, ময়দানে গুলি চালিয়ে বন্দিদের হত্যা আর গণতান্ত্রিক অধিকারের জন্য প্রতিবাদ জুড়ে ছিল পাঁচ বছর।

ভরে উঠছিল জেল, রাজনৈতিক কর্মী এবং বিনা বিচারে বন্দিতে। জেলেই যেতে হয়েছিল সাংবাদিকদের একাংশকেও। সিপিআই(এম), বামপন্থী কর্মীরা হয় আত্মগোপনে, নয়তো জেলে। এলাকায় কাজ করছেন যাঁরা, করছেন প্রাণ হাতে। মৃণাল সেনের ‘পদাতিক’-র মতো একাধিক চলচ্চিত্র যে সময়ের অনেকটা ধরে রেখেছে সেলুলয়েডে।

বাতাসের বারুদের গন্ধে দমবন্ধ অবস্থার মধ্যে ১৯৭৭-এ হয় নির্বাচন। জয়ী হয় বামফ্রন্ট। সাতাত্তরে নির্বাচনের পর বামফ্রন্ট সরকার গড়ে উঠেছিল এমনই বিবর্ণ চালচিত্রে। রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তির দাবি আগেই তুলেছিলেন বামপন্থীরা। মুখ্যমন্ত্রী পদে শপথ নিয়ে সব রাজনৈতিক বন্দি, বিনা বিচারে বন্দিদের মুক্তি ঘোষণা করলেন জ্যোতি বসু। রাজনৈতিক গণতন্ত্রের পক্ষে সেই ঘোষণা রাজ্যকে তার বিকল্প খুঁজতে পথ দেখিয়েছিল। পরের ৩৪ বছরে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের কর্মীদের দরজায় কড়া নাড়েনি কোনও খাকি উর্দিধারী। গত দশ বছর অবশ্য সেই পরিবেশ ফেরানোর ব্যবস্থা হয়েছে। সোশাল মিডিয়ায় তৃণমূল কংগ্রেস বা দলের নেতানেত্রীদের সমালোচনা করায় হুমকি ভেসেছে, ফোন এসেছে থানা থেকে।

প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী এবং সিপিআই(এম) নেতা বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য স্মৃতিচারণ করেছেন ‘ফিরে দেখা’-তে। তিনি লিখেছেন, ‘‘বামফ্রন্ট সরকারের মন্ত্রিসভার প্রথম বৈঠকেই রাজ্যের রাজবন্দিদের মুক্তি দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। এটি ছিল গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। ইন্দিরা গান্ধীর স্বৈরশাসনে বহু মানুষ গ্রেপ্তার হয়েছিলেন এবং জেল খেটেছিলেন। আশা ছিল কেন্দ্রীয় জনতা দলের সরকার (ইন্দিরা গান্ধীর পরাজয়ের পর আসীন) নীতিগত সিদ্ধান্ত নেবে। বাস্তবে কোনও সিদ্ধান্তই তারা নিতে পারেনি।

‘‘আর পশ্চিমবাংলায় ছিল বিশেষ সমস্যা। নকশালপন্থী আন্দোলন যখন খতম অভিযানে পর্যবসিত তখন বহু তরুণ জেলে গেলেন এবং বন্দিই রইলেন। সব মিলিয়ে এরাজ্যের অবস্থাটা ছিল অসহনীয়। দমদম সেন্ট্রাল জেল, প্রেসিডেন্সি, আলিপুর ছাড়াও জেলা ও মহকুমা জেলগুলি ভর্তি হয়ে গিয়েছিল…’’

বন্দিমুক্তি দিয়ে সূচনা, পরের সাড়ে তিন দশকে টানা সরকার পরিচালনার বিভিন্ন পর্বে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে রাজনৈতিক অধিকারে। আরেকটি সিদ্ধান্ত ছিল রাজনৈতিক কারণে বরখাস্ত সরকারি কর্মচারী, শিক্ষকদের চাকরি ফিরিয়ে দেওয়া। গণতান্ত্রিক অধিকারকে ফের ফিরিয়ে আনা হয়েছে, সম্প্রসারিত করা হয়েছে। রাজনৈতিক বিরোধীদের মর্যাদা স্বীকৃত হয়েছে। বিধানসভা সরগরম হয়েছে বিভিন্ন সময়ে, উত্তেজনাও থেকেছে। কিন্তু দুর্নীতিতে তদন্তে দাবি তুলে বিরোধী কোনও বিধায়ককে মারধর খেতে হয়নি।

মনে পড়বে নিশ্চয়, বিধানসভার মধ্যে গৌরাঙ্গ চ্যাটার্জি এবং দেবলীনা হেমব্রমকে মারধর। চ্যাটার্জি মাথায় গুরুতর চোট পেয়েছিলেন, সরকারি হাসপাতালে ‘কিচ্ছু হয়নি’ বলে ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছিল তাঁকে। বাইরে পরীক্ষায় আঘাত ধরা পড়ে। অসহিষ্ণু প্রতিহিংসা এভাবে ধেয়ে আসত না ৩৪ বছরে। পৌরসভা, পঞ্চায়েতের বিভিন্ন স্তরে বোর্ড পরিচালনা করেছেন বিরোধীরা। বামফ্রন্টের কোনও নেতা দল ভাঙিয়ে বা ভয় দেখিয়ে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিকে তুলে এনে দখল করার হুমকি দেননি। করেও দেখাননি। এসব এখন এরাজ্যের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে জড়িয়ে দিয়েছে তৃণমূল।

Spread the word

Leave a Reply