দখলের ১১ বছর : তৃণমূলের নরক গুলজার,মমতার সব ভাষ্যের হার,জিত সেই বামপন্থারই – চন্দন দাস…

৫ জুন, ২০২২ রবিবার

প্রথম পর্ব

মমতা ব্যানার্জি বলেছিলেন কৃষি বনাম শিল্প। তাঁর প্রচার ছিল — বামফ্রন্ট ‘ভাতের কারখানা’, অর্থাৎ কৃষিজমি ধ্বংস করে বড় বড় শিল্পপতিদের হাতে জমি তুলে দিতে চাইছে।
১১-১২ বছর আগে এই ছিল আজকের মুখ্যমন্ত্রীর ভাষ্য।
বামফ্রন্ট বলেছিল — কৃষির বিকাশের উপর দাঁড়িয়ে শিল্প। রাজ্যের মোট জমির ১% লাগবে প্রস্তাবিত শিল্পগুলি গড়ে তুলতে। শিল্প দরকার, কারন — কে শিল্প গড়ছে বড় কথা নয়। কত কাজ হবে তাই প্রধান বিচার্য বিষয়। নতুন প্রজন্মের কাজের সুযোগ দরকার, যা কৃষিক্ষেত্র আর আগের সৃষ্টি করতে পারছে না।
১১ বছর পর পশ্চিমবঙ্গ বলছে ওই ব্যাখ্যাই ঠিক ছিল। আমরা পিছিয়েছি। অনেকটা।
দূরদৃষ্টি বামফ্রন্টের ছিল। মমতা ব্যানার্জির ছিল স্যাটানিক লক্ষ্য — ‘স্বর্গে দাসত্ব করার চেয়ে নরকে রাজত্ব করা ভালো।’
১১ বছর মমতা-শাসন দেখল পশ্চিমবঙ্গ। তৃণমূলের নরক গুলজারে কোথায় এসে দাঁড়িয়েছি আমরা? চলুন যাই পুরুলিয়ায়, মমতা ব্যানার্জির প্রশাসনিক সভায়।


শুধু তাঁর সভার মঞ্চ সাজানোর জন্য খরচ হয় সর্বনিম্ন ৮০লক্ষ টাকা। ২ কোটি ৪লক্ষ টাকা খরচের উদাহরণও আছে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির প্রশাসনিক সভা আয়োজন সংক্রান্ত পূর্ত দপ্তরের টেন্ডারগুলি হিসাব তাই বলছে। এই বিপুল খরচ কখন? যখন রাজ্য সরকারই বলছে রাজ্যের ধার চলতি আর্থিক বছর শেষে পৌঁছোবে ৫লক্ষ ৮৬ হাজার ৪৩৮কোটি টাকায়। ২০১১-র মে-তে যা ছিল ১লক্ষ ৯১হাজার কোটি টাকার মত। ধার বেড়েছে প্রায় ২০৮%।

মুখ্যমন্ত্রীর চার কিলোমিটার মিছিলে খরচ ১ কোটি ৩০ লক্ষ



ধারে জর্জরিত রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী এমনই এক ব্যয়বহুল সভা করেছেন পুরুলিয়ায়। গত ৩১মে। সেই সভাতে নিজের দলে ছাত্রযুবদের টেনে নামানোর কৌশল বাতলেছেন তিনি। মহিলা কর্মীদের সেই দায়িত্ব বুঝিয়েছেন। কী টোপ দিতে হবে তরুণদের? তাও স্পষ্ট করেছেন তৃণমূল নেত্রী।
তিনি বলেছেন,‘‘মা, বোনেরা ছেলেমেয়েদের বলবেন, ঘর থেকে বের হও। তৃণমূল কংগ্রেস কর। তৃণমূল কংগ্রেস করলে দেখবি, অনেক কিছু পাবি। তোদের ভবিষ্যৎ দাঁড় করিয়ে দেবে তৃণমূল কংগ্রেস। আর কেউ পারবে না।’’
বক্তব্যে দুটি বিষয় স্পষ্ট। প্রথমত, তরুণরা, যাঁদের চোখে স্বপ্ন, তাঁদের তৃণমূলে ‘করতে’ অনীহা। দ্বিতীয়ত, প্রলোভন দেখাতে হবে ছাত্রযুবদের টানতে। এই দুটি ব্যাখ্যার মোদ্দা কথা — মমতা-শাসনের ১১ বছরে ছাত্র যুব অংশ মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত। এটা এই প্রজন্মের উপলব্ধিতে পরিণত হয়েছে। মমতা ব্যানার্জি বুঝেছেন। তাই ‘অনেক কিছু পাবি’-র প্রতিশ্রুতি।
এর একটি প্রেক্ষাপটও আছে। আনিস খানের খুনের বিচার চাওয়া মিছিল কিংবা এসএসসির নিয়োগ দুর্নীতির প্রতিবাদে অবরোধ — আজকের পশ্চিমবঙ্গে লড়াইয়ের ঝান্ডা মূলত যুবদের শক্ত কাঁধে। এবং বিজেপি, সঙ্ঘের যাবতীয় বিভাজনের চেষ্টা সত্বেও লড়াকু ছাত্রযুবরা বামপন্থী আন্দোলনের উজ্বল ভবিষ্যতের স্পষ্ট ইঙ্গিত হয়ে উঠেছেন।
এই পরিস্থিতিতে মমতা ব্যানার্জির কিছু পাইয়ে দিয়ে ছাত্রযুবদের দলে টানার কৌশল।
প্রশ্ন হল — কী দিতে পারে তৃণমূল বিপর্যস্ত ছাত্র যুবদের?
কিছু পাওয়ার জন্য রাজনৈতিক দলে ঢুকে পড়া — এটি একটি দর্শন। দক্ষিণপন্থার, ধান্দার দর্শন। মমতা ব্যানার্জি সেই রাজনীতির অন্যতম আইডল। পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতির পরিমন্ডলে গত ১১ বছরে মমতা ব্যানার্জি এই দর্শনের প্রভূত বিস্তার ঘটিয়েছেন। কিন্তু ‘দাঁড়িয়েছে’ প্রধানত তৃণমূলের নেতারা, বিধায়ক-মন্ত্রীরা। অনেকের বিরাট বাড়ি হয়েছে। তোলা, কাটমানি, কমিশন থেকে কোটি কোটি টাকা আয় করেছেন তারা। ‘ভবিষ্যৎ দাঁড়’ করাতে তৃণমূল নেতারা সারদার কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন। গ্রাম থেকে কালীঘাট — তৃণমূলের নানা পর্যায়ের নেতাদের বিপুল সম্পত্তি হয়েছে। সে সব নিয়েই বিস্তর চুরি, কাটমানি, কমিশন, তোলা আদায়, গোরু থেকে কয়লা, নানা কিছু পাচারের অভিযোগ।

চুরি আর দুর্নীতি গত ১১ বছরে সমার্থক হয়ে পড়েছে পশ্চিমবঙ্গে। স্বাভাবিকভাবেই সমাজের তরুণ অংশের এমন দলের প্রতি ক্ষোভ, বিরোধিতাই স্বাভাবিক।

মমতা ব্যানার্জির শাসনে কী পাওয়ার কথা ছিল রাজ্যবাসীর? বিশেষত তরুণ অংশের?
মুখ্যমন্ত্রীর বহুকাঙ্খিত চেয়ারে পৌঁছোনর আগে, ২০১১-র দলীয় ইশ্‌তেহারে মমতা ব্যানার্জি অনেক প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন মানুষকে ‘দাঁড় করাতে।’ যেমন — শিল্পে সবুজ বিপ্লব আনবেন তিনি। প্রতিটি মহকুমায় ১০টি করে ন্যূনতম শিল্প হবে। শূণ্যপদ পূরণ করবেন। বছরে ১ কোটি বেকারের চাকরি দেবেন। চাকরিতে সংখ্যালঘুদের বিশেষ অগ্রাধিকার মিলবে। কৃষক ফসলের দাম পাবেন। ফসলের বিপণনের ব্যবস্থা হবে। স্বাস্থ্য মিশন হবে। আইনশৃঙ্খলার প্রভূত উন্নতি হবে। প্রশাসনে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ হবে না। আরও প্রতিশ্রুতি ছিল। অনেক। সবের উল্লেখ অর্থহীন। কারন কোন প্রতিশ্রুতি পূরণ হয়নি।
মমতা ব্যানার্জি সেই সম্ভাবনায় মারাত্মক হামলা চালিয়ে, ক্ষতবিক্ষত করে সরকারে এসেছিলেন। এখন পশ্চিমবঙ্গ কেমন জায়গায় পৌঁছেছে? কয়েকটি তথ্য এবং ঘটনা এই ক্ষেত্রে আরশি হতেই পারে।
রাজ্যের বাসিন্দা ১১জন পরিযায়ী শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে ভিন রাজ্যে — ১৮এপ্রিল থেকে ২২মে-র মধ্যে। অর্থাৎ ৩৪দিনে ১১জন! তাঁদের মধ্যে আত্মঘাতী ১জন। বাকিদের মৃত্যু দুর্ঘটনায়। এমন ঘটনা, ভিন রাজ্যে অসহায় মানুষের মৃত্যুর সংখ্যা গত ১১ বছরে অনেক।
পশ্চিমবঙ্গ থেকে বিভিন্ন রাজ্যে শস্তা শ্রম যায়। যাঁদের নাম — পরিযায়ী শ্রমিক। লকডাউনের সময় বোঝা গেছে প্রায় ৩০-৩৫লক্ষ রাজ্যবাসী ভিন রাজ্যে কাজ করেন। রাজ্যে কাজ নেই বলে।

পরিযায়ী শ্রমিক


মমতা ব্যানার্জির সরকার গড়েছিল ‘এমপ্লয়মেন্ট ব্যাঙ্ক।’ এখন দেখা যাচ্ছে রাজ্য সরকারই সেখান থেকে লোক নেয় না। সম্প্রতি টেন্ডার ডেকে ঠিকাদার মারফত গ্রুপ সি, গ্রুপ ডি নেওয়ার উদ্যোগ লক্ষ্য করা গেছে রাজ্য সরকারের সংস্থার মধ্যেই। দু’ বছর আগে, ২০২০-র ৩ জুন নতুন আর একটি ব্যাঙ্কের ঘোষণা করেছিলেন মমতা ব্যানার্জি। নাম দিয়েছিলেন ‘স্কীল ব্যাঙ্ক।’ বিষয়টি কী? তিনি বলেছিলেন,‘‘জেলাগুলিকে বলছি যাঁরা ফিরে এসেছেন তাঁদের তালিকা বানান। তাঁরা কে কী পারেন তারও তালিকা করুন। কেউ একশো দিনের কাজ পারে। কেউ সোনার কাজ কিংবা জরির কাজ। একটা ‘স্কিল ব্যাঙ্ক’ করার পরিকল্পনা করেছি আমরা। ছোট মাঝারি এবং ক্ষুদ্র শিল্প দপ্তরের মাধ্যমে এদের কাজে লাগানো হবে।’’
সেই ব্যাঙ্কের কোনও অস্তিত্ব রাজ্যে নেই!
অস্তিত্ব এমন অনেক কিছুর নেই। যেমন বিনিয়োগের। যা এলে শিল্প হবে। শিল্প হলে কাজ হবে। কিন্তু হয়নি। মমতা ব্যানার্জি অবশ্য ঘোষনা চালিয়ে গেছেন। উদাহরণ? চলতি বছরের ২১-২২ এপ্রিল ৬ষ্ঠ বিশ্ববঙ্গ শিল্প সম্মেলন করেছে তৃণমূল সরকার। এসএসসি-র নিয়োগ দুর্নীতিতে অভিযুক্ত পার্থ চ্যাটার্জি এখন রাজ্যের শিল্পমন্ত্রী। এবারের শিল্প সম্মেলনে ৩লক্ষ ৪২ হাজার ৩৭৫ কোটি টাকার প্রস্তাব এসেছে বলে মমতা ব্যানার্জি ঘোষনা করেছেন। ৪০লক্ষ কর্মসংস্থান হবে ওই বিনিয়োগের ফলে তাও দাবি করেছেন তিনি।


তাঁর দাবির দুরবস্থার প্রমাণ? ২০১৫ থেকে ২০১৯ — রাজ্যে পাঁচটি ‘বিশ্ববঙ্গ শিল্প সম্মেলন’ করেছেন তিনি। অনেক টাকা খরচ করে। সরকারের দাবি, পাঁচটি সম্মেলনে মোট ১২,৩৫, ৫৭৮ কোটি টাকার বিনিয়োগ প্রস্তাব রাজ্যে এসেছে।
কিন্তু বাস্তব কী? একই রাজ্য সরকারের মারফত কেন্দ্রেীয় সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রক জানাচ্ছে, ২০১৫ থেকে ২০১৯ — এই পাঁচ বছরে পশ্চিমবঙ্গে বিনিয়োগের লিখিত প্রস্তাব এসেছে ৩৭,৫০৪ কোটি টাকার। মমতা ব্যানার্জির ঘোষণার তা ৩.০৪২%।
অথচ ওই পুরুলিয়ার সভাতেই মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি বলেছেন, ‘‘পুরুলিয়ার ছেলেদের আর চাকরি-বাকরির জন্য বাইরে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। ওটা জঙ্গলমহল সুন্দরী। ৭২হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ হবে। লক্ষ লক্ষ ছেলেমেয়েরা চাকরি করবে।’’
কেন বলছেন? কাজের হাহাকার মারাত্মক। মমতা ব্যানার্জি কাজের সুযোগ তৈরিতে ডাহা ফেল। এটা শুধু আর বিরোধীদের প্রচারের বিষয় নয় — জনমানসের দৃঢ় উপলব্ধি।
তাৎপর্যপূর্ণ হল — ডিআইপিপিসহ একাধিক সংস্থার রিপোর্ট অনেক আগে থেকেই দেখাচ্ছে, বিনিয়োগের সম্ভবনায় বামফ্রন্ট সরকারের সময়কালে মহারাষ্ট্র, ওড়িশা, তামিলনাড়ু, গুজরাটের মত রাজ্যের সঙ্গে টক্কর নিচ্ছিল পশ্চিমবঙ্গ।
কিন্তু মমতা ব্যানার্জির শাসনে?
২০২১-এ রাজ্যওয়াড়ি শিল্প প্রস্তাবে পশ্চিমবঙ্গ ১৫ নম্বরে। দেশের মোট প্রস্তাবের ০.৭২% প্রস্তাব এসেছে রাজ্যে।

এমন সময়ে তৃণমূল সরকার মূলধনী খাতে, পরিকাঠামো উন্নয়নে খরচ কমিয়ে দিচ্ছে! মূলধনী খাতের বরাদ্দ, খরচ কমানোর অর্থ পরিকাঠামো উন্নয়নে ধাক্কা। কাজের সুযোগ কমে যাওয়াই মূলধনী খাতে খরচ কমানোর প্রত্যক্ষ প্রভাব। তাই হচ্ছে মমতা-শাসনে। ২০২০-২১আর্থিক বছরে মূলধনী খাতে বাজেট বরাদ্দ ছিল ৩২হাজার ৭৭৪ কোটি টাকা। সেই ক্ষেত্রে সংশোধিত বরাদ্দের হিসাব বলছে খরচ নামিয়ে আনা হয়েছে ১৯ হাজার ১৭৫ কোটি টাকায়। অর্থাৎ মূলধনী খাতে ব্যয় কমানো হয়েছে ১৩ হাজার ৫৯৯ কোটি টাকা।

Spread the word

Leave a Reply