ইস্ট ওয়েস্ট মেট্রো ও দীর্ঘসূত্রিতা

১৩ফেব্রুয়ারি উদ্বোধন হল কোলকাতা ইস্ট -ওয়েস্ট মেট্রোর। ১৪ ফেব্রুয়ারি থেকে জনগণের জন্য খুলে দেওয়া হয় সেক্টর V থেকে সল্টলেক স্টেডিয়াম পর্যন্ত ৪.৮৮ কিমি যাত্রাপথ । ভারতের প্রথম মেট্রো পরিষেবা চালু হওয়া শহর তার দ্বিতীয় মেট্রো পেল ৩৬ বছর পরে। ইতিমধ্যেই দিল্লি, মুম্বই,হায়দ্রাবাদ,বেঙ্গালুরুতে সর্বাধুনিক মানের মেট্রো চালু হয়ে গেলেও কোলকাতা উত্তর-দক্ষিণ মেট্রো এখনো মান্ধাতার আমলের রেক দিয়েই কাজ চালিয়ে যাচ্ছে যার ফলে মাঝে মধ্যেই দুর্ঘটনা এমনকি মৃত্যু পর্যন্ত ঘটেছে। অথচ বাম আমলে কোলকাতা ও শহরতলি মিলিয়ে মোট ৫টি মেট্রো প্রকল্পের কাজ শুরু হয়েছিল।

১.ইস্ট-ওয়েস্ট
২. জোকা – বিবাদীবাগ
৩. নিউ গড়িয়া-বিমানবন্দর
৪. নোয়াপারা-বারাসাত
৫. ব্যারাকপুর-বরাহনগর-দক্ষিণেশ্বর
প্রকল্পগুলির নমুনা হিসাবে নিত্য যাত্রীরা অসংখ্য পিলার ও অর্ধনির্মিত বহু স্টেশন শহর ও শহরতলি জুড়ে রোজই দেখতে পান। কাজের অগ্রগতি যৎসামান্যই । কেন্দ্র বা রাজ্য কোন সরকারেরই বিশেষ হেলদোল নেই এই প্রকল্পগুলো রূপায়নে। অথচ শুরুটা কিন্তু এমন ছিল না।

২০০৩ সালে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সমীক্ষকদের দিয়ে তৈরি করা রিপোর্টের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত হয় যে রাজ্য সরকার, কেন্দ্রের আবাসন ও নগরোন্নয়ন মন্ত্রকের যৌথ উদ্যোগে ইস্ট ওয়েস্ট মেট্রোর কাজ শুরু হবে। ঋণ সাহায্য করবে Japan Bank for International Co-operation (JBIC)।২০০৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি ইস্ট ওয়েস্ট মেট্রোর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের মধ্য দিয়ে কাজ শুরু হয় যদিও সেইদিনও তৃণমূল কংগ্রেস মমতা ব্যানার্জীর নির্দেশে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে কালো পতাকা দেখানোর মত কদর্য কাজ করেছিল। আজ সেই মমতাই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হয়ে কাঁদুনি গাইছেন কেন তাকে ইস্ট ওয়েস্ট মেট্রোর উদ্বোধনে ডাকা হয়নি।
উনি হয়ত ইতিহাসটা ভুলে গেছেন। টালিগঞ্জ থেকে গড়িয়া মেট্রো রুটের সম্প্রসারণের কাজে ৩৩শতাংশ ব্যয়বহন করেছিল পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকার। রেলমন্ত্রী হওয়ার কয়েক সপ্তাহ বাদে তার ফিতে কেটে দেন নতুন রেলমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি ।নতুন রেক না এনেই উদ্বোধন করে দেওয়ার ফল কলকাতাবাসীকে প্রায় আট মাস ধরে ভুগতে হয়েছিল, সে অন্য কথা। কিন্তু সেই সম্প্রসারণের ৩৩ শতাংশ যার অবদানে, সেই রাজ্য সরকারের প্রধান মুখ্যমন্ত্রীকে ডাকার সৌজন্য মমতা সেদিন ভুলেছিলেন।

হুমকি দেওয়া হয় শিয়ালদা আর হাওড়া স্টেশন চত্বরে মেট্রো স্টেশন করতে দেওয়া হবে না । তৎকালীন রাজ্য সরকার রাজনীতির বদলে রাজ্যের উন্নয়নে বেশী জোর দিয়েছিলেন। তারা নিজেদের শেয়ার রেলের হাতে তুলে দেন । বর্তমানে KMRCL বা কোলকাতা মেট্রো রেল কর্পোরেশন লিমিটেডের ৭৪% শেয়ার রেল মন্ত্রকের আর বাকি ২৬% আবাসন ও নগরোন্নয়ন মন্ত্রকের । গোটা ভারতে এই ইস্ট ওয়েস্ট মেট্রোই একমাত্র মেট্রো পরিষেবা যাতে রাজ্য সরকারের কোন অংশীদারীত্ব নেই ।
মজার বিষয় হল এখন মিডিয়ার একটা অংশ এবং কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার গোটা ঘটনাকে এমনভাবে উপস্থাপন করছে যেন ২০১১ এর আগে এ রাজ্যে বামফ্রন্ট সরকারের আমলে পরিবহন ব্যবস্থার কোন উন্নয়নই ঘটেনি ! কিন্তু বাস্তব হচ্ছে এটাই যে ২০০০ সাল থেকেই এরাজ্যে পরিবহন ব্যবস্থার ক্ষেত্রে কাঠামোগত বিপুল পরিবর্তনের সূচনা ঘটানো হয়। শহর ও শহরতলিতে রাজ্য সড়ক নির্মাণ এবং নতুন নতুন ফ্লাইওভার(সেতু) নির্মাণের মাধ্যমে শহরের বাকি রাস্তাগুলির সাথে সংযোগ স্থাপনের কাজেও ঐ সময় থেকে বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়। এছাড়াও কেন্দ্র-রাজ্য প্রকল্প জেএনইউআরএম-এর বেশ কিছু কাজ শহর জুড়ে সুরু করা হয় । অপরদিকে জাপান ইন্টারন্যাশনাল কোঅপারেশন এজেন্সি বা জাইকার সহায়তায় কলকাতার বুকে জুড়ে যাচ্ছে নতুন নতুন ফ্লাইওভার। আরো প্রস্তাব আসছিল। তারমধ্যেই সমীক্ষা হলো ব্যারাকপুর থেকে জোকা পর্যন্ত এলআরটি বা অত্যাধুনিক হাল্কা রেল পথ, যা রাস্তার ধারে নির্মিত স্তম্ভের উপর দিয়ে চলবে। ব্যারাকপুরের দিক থেকে বিটি রোড, আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রোড হয়ে মৌলালি থেকে ঘুরে ধর্মতলা হয়ে দক্ষিণ দিকে চলে যাবে। প্রকল্প রচনা হয়েছিল শিয়ালদহ স্টেশন থেকে মহাকরণ পর্যন্ত রাস্তার কিছুটা উপর দিয়ে চলন্ত ফুটপাতেরও।

কিন্তু রাজ্য সরকার যখন এই প্রকল্পগুলো নিয়ে আলোচনা চালাচ্ছে তখন তদানীন্তন রেলমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায় রাতারাতি জোকা – বিবাদীবাগ, নিউ গড়িয়া-বিমানবন্দর এইদুটো মেট্রোর ঘোষণা করেন। স্বাভাবিকভাবেই একই যাত্রাপথে দুইধরণের রেল যোগাযোগ ব্যবস্থার প্রয়োজন নেই এই বিবেচনা থেকে রাজ্য সরকার তাদের পরিকল্পনা স্থগিত করে দেয়।

সমীক্ষা হয়েছিল কলকাতা ঘিরে বড় একটি রিং রোড বা চক্রাকার পথের। যার বাইরে থাকবে বেশ কয়েকটি ট্রাক টার্মিনাল। বড় ট্রাক শহরে ঢুকবেনা। বড়বাজারের বিকেন্দ্রীকরণের দীর্ঘদিনের ভাবনা বাস্তবায়িত হবে। গঙ্গার উপর দিয়ে একটা সেতু বজবজের কাছে হবে এই রিং রোডের অংশ হিসাবে। হলদিয়া শিল্পকেন্দ্র ছুঁয়ে সেই পথ ঘুরে আবার উত্তরদিকে শহরে ঢোকার পথে যুক্ত হবে। নিবেদিতা সেতুর কাজ চলছিল। আহিরিটোলায় আরো একটি সেতু দিয়ে হাওড়া কলকাতা যোগাযোগ বৃদ্ধির ভাবনা হচ্ছিল। বিদ্যাসাগর সেতুর সফল রূপায়ন উদ্বুদ্ধ করেছিল। ঐ রিং রোড বরাবর শহর ঘিরে একটা রেলপথের প্রস্তাবও ছিল। শহরের মধ্যে আধুনিক সিগন্যালিং ও গ্রীন করিডোর করা ছাড়াও রাস্তার আশেপাশের যত্রতত্র বিজ্ঞাপনের বোর্ড, স্তম্ভ শৃঙ্খলায় আনা, পথের দিক নির্দেশনার বোর্ড লাগানোর কাজ ও বাস যাত্রীর অপেক্ষা করার শেডের নকশার কাজেও হাত দেওয়া হয়েছিল।

যে কথা মিডিয়াতে একবারও বলা হচ্ছে না – ২০১১এর আগে যে অংশে পিলার গাঁথার কাজ প্রায় ৯০ভাগ হয়ে গিয়েছিল, সেটুকু অংশেই মেট্রোর উদ্বোধন হচ্ছে ২০২০ সালে এসে। অথচ কথা ছিল ২০১৪ এর মধ্যেই সেক্টর V থেকে হাওড়া ময়দান অবধি ১৬.৫ কিমি রুটেই ট্রেন পরিষেবা চালু হবে। কেন্দ্রীয় রেলমন্ত্রী পীযূশ গয়াল বলেছেন ২০২২ এর মধ্যে নাকি হাওড়া ময়দান অবধি পরিষেবা চালু হয়ে যাবে !
কেন এতো দেরি ?

১. রেলমন্ত্রককে কাজে লাগিয়ে হাওড়া ও শিয়ালদায় মেট্রো স্টেশনের পরিকল্পনাকে বাগড়া দেওয়া । যাতে তৎকালীন রাজ্য সরকার বাধ্য হয় নিজের অংশ রেলের হাতে ছেড়ে দিতে ।

২. দত্তাবাদ এলাকায় লোক খেপিয়ে জমি অধিগ্রহণ এর কাজ কয়েক বছর ধরে আটকে রাখা।

৩. পূর্ব পরিকল্পনা ছিল ইস্ট-ওয়েস্ট ও উত্তর-দক্ষিণ (নোয়াপারা- কবি সুভাষ) এই দুই মেট্রো রেলপথের জংশন হবে সেন্ট্রাল মেট্রো স্টেশন কিন্তু শেষ মু্হূর্তে ব্যবসায়ী সমিতি ও অন্যান্যদের ক্ষেপিয়ে তুলে কাজ বন্ধ রাখে রাজ্য সরকার। সেন্ট্রালের বদলে এসপ্ল্যানেডকে জংশন করার কাজ শুরু করতে গিয়ে অতিরিক্ত আরো কয়েক হাজার কোটি টাকা খরচ হয় ও কাজ পিছিয়ে যায় ২ বছর মত।

আমাদের শহরের গণ পরিবহনকে আরো শক্তিশালী করার এই পদক্ষেপে অপ্রয়োজনীয় দেরির জন্য বর্তমান রাজ্য সরকার ও তার প্রধান মমতা বন্দোপাধ্যায় ও বর্তমান কেন্দ্রের সরকার তাদের দায় এড়াতে পারে না।

Spread the word

Leave a Reply